আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বালাগঞ্জ মুক্ত দিবস আজ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-১২-০৭ ১২:১৮:৫৫

মো. জিল্লুর রহমান জিলু, বালাগঞ্জ প্রতিনিধি ::  আজ বালাগঞ্জ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি, বঙ্গবীর জেনারেল এমএজি ওসমানীর পৈত্রিক ভূমি বালাগঞ্জ উপজেলা (বর্তমান ওসমানীনগর উপজেলাসহ) পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। আজ বালাগঞ্জবাসীর কাঙিক্ষত বিজয়ের সেই গৌরবময় স্মরণীয় দিন, বালাগঞ্জ মুক্ত দিবস।

সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর সকাল ৬টার সময় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাতাছড়া থেকে ৪০জন মুক্তিযোদ্ধা বালাগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল কামালের নেতৃত্বে এ বাহিনীর অন্যান্য সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন মুছব্বির বেগ, শফিকুর রহমান, মনির উদ্দিন, ধীরেন্দ্র কুমার দে, নীহারেন্দু ধর, আব্দুল খালিক, জবেদ আলী, সিকন্দর আলী, আমান উদ্দিন, লাল মিয়া, মনির উদ্দিন আহমদ, মজির উদ্দিন আহমদ, মো. সমুজ আলী, আব্দুল বারী প্রমুখ।

এদের মধ্যে ২৬জন পূর্ব পরিকল্পণা অনুযায়ী পথে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলা সদরে থেকে যান। বাকী ১৪ জনের দলটি ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর অধিনায়ক আজিজুল কামালসহ ফেঞ্চুগঞ্জ থানার মাইজগাও এলাকার আব্দুল গণি মাস্টার ও বদরুল হক নিলুর বাড়ীতে উঠেন। সেখান থেকে একই রাত ১২টার সময় রওয়ানা হয়ে রাত ২টার সময় ইলাশপুর রেল সেতুর নিকট অবস্থান গ্রহণ করেন। পরদিন ভোরে একদল পাক সেনা সিলেট থেকে ফেঞ্চুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর সাথে মুখোমুখি হয়।

সেখানে প্রায় আধা ঘন্টা যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানী সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত ২টি এসকেএস রাইফেল ও বেশ কিছু গোলা বারুদ ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ইলাশপুর সেতু অতিক্রম করেন। এ সময় বড়লেখা থেকে ২৬ জনের দলটিও সেখানে এসে পৌঁছে যায়। এতে উভয় দলের মনোবল আরো বেড়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা ইলাশপুর সেতুর অবস্থান থেকে ৬ ডিসেম্বর ভোর রাতে রওয়ানা হয়ে সন্ধ্যা ৭টার সময় প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বর্তমান বালাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপে-ক্সের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হন। এরপর সেখানে অবস্থান করে শুরু হয় তথ্য সংগ্রহের পালা। সংবাদ পাওয়া যায়, বালাগঞ্জ থানায় পাক হানাদার বাহিনী নেই, তবে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে একদল বাঙ্গালী পুলিশ রয়েছে। সেদিন রাজশাহীর বদিউজ্জামান, বিয়ানীবাজার নিবাসী ডা. জাকারিয়া ও কাজীপুর নিবাসী আব্দুছ সুলতান বার্তা বাহকের কাজ করেন। ইতোমধ্যে রাত নেমে আসে। রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা থানা ভবনে অবস্থানকারী পুলিশ বাহিনীকে ঘেরাও করে ফেলেন।
৭ ডিসেম্বর সকালে বার্তা বাহক দুই জনকে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট আত্মসমর্পণের নির্দেশ পাঠানো হয়। পুলিশ বাহিনী তখন দুই ঘণ্টা সময় প্রার্থনা করে। কিন্তু অধিনায়ক আজিজুল কামাল ঘোষণা করেন বড়জোড় ১০ মিনিট সময় দেওয়া যেতে পারে। অতঃপর সিদ্ধান্ত হয় পাক হানাদারের ওই দোসরা সকাল ৯টায় অস্ত্র সমর্পণ করবে। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক পুলিশ বাহিনী থানা ভবনের মালখানায় অস্ত্র জমা দেয় এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সকাল পৌনে ১০টায় মুক্তি বাহিনীর অধিনায়কের নিকট চাবি হস্তান্তর করে।

সেদিন আত্মসমর্পণের পর উপজেলা সদরস্থ সাব-রেজিস্ট্রারী অফিস প্রাঙ্গণে মুক্তিকামী অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে। অধিনায়ক আজিজুল কামাল হাতে স্টেনগান নিয়ে উপস্থ্তি জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা শান্ত থাকুন, এখানকার সব কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, বালাগঞ্জের পুলিশ বাহিনী এবং রাজাকাররা আমাদের কাছে সালেন্ডার করেছে। আজ আমরা মুক্ত।

তারপর সকাল ১০টার সময় থানার সমুখস্থ প্রাঙ্গণে কুয়াশাঘন সকালে মাঠের এক পার্শ্বে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সারিবদ্ধ ভাবে লাইন করে অবস্থান গ্রহণ করেন। সবার হাতে অস্ত্র। অধিনায়ক আজিজুল কামাল দলের মুক্তিবাহিনীর ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে উপস্থিত জনতার সামনে পরিচয় করিয়ে দেন। এসময় উৎসুক জনতা বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের অভিবাদন জানান। আর মাঠে জড়ো হওয়া সবাই চুড়ান্ত বিজয়ী হয়ে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ছড়িয়ে পড়েন বালাগঞ্জের গ্রাম থেকে গ্রামে।

বালাগঞ্জ মুক্ত দিবস নিয়ে আলাপকালে বিজয়ী দলের অন্যতম সদস্য দেওয়ান বাজারের জামালপুর নিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা মজির উদ্দিন আহমদ ও উজিয়ালপুর নিবাসী মো. সমুজ আলী বলেন, একাত্তরের সেই দিনের কথা জীবনে ভুলার নয়। দেশকে শত্রু মুক্ত করতে আমরা জীবন বাঁজি রেখে যুদ্ধ করেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের স্বাধীনতার সকল স্বপ্ন, প্রত্যাশা আজও পূর্ণতা পায়নি। তবে দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচার প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন, কোন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা কোন দেশপ্রেমিক নাগরিক এদের বিচারের বিরোধীতা করতে পারে না। আমরা অবশ্যই যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচার চাই। আমরা বিশ্বাস করি স্বাধীনতা বিরোধীদের দিয়ে দেশের প্রকৃত উপকার বা উন্নয়ন হতে পারে না। আজ হোক বা কাল, সকল যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচার বাংলার মাঠিতে হবেই হবে।

তবে আক্ষেপ প্রকাশ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মজির উদ্দিন আহমদ সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকহারে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নাম দিয়ে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে সরকারী চাকুরীসহ রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক বিভিন্ন ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি এসব অপতৎপরতা বন্ধে সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/০৭ ডিসেম্বর ২০১৭/জেআরজে/এমকে-এম


শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন