আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ব্যাডমিন্টন তারকা সিলেটের মাঙ্গালের গল্প

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৯-২৮ ১৭:৫৮:১২

মিসবাহ উদ্দীন আহমদ :: মাঙ্গাল। পুরোনাম মাঙ্গাল সিংহ। মাইবাম মাঙ্গাল নামেও পরিচিতি রয়েছে তার। সতেরো বছর বয়সী এ কিশোর সিলেটকে এনে দিয়েছেন অসামান্য সাফল্য। নগরীর শিবগঞ্জ খরাদিপাড়ার আল্পনা ৫৯ নাম্বার বাসার বাসিন্দা সাবেক ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় চন্দ্র শেখর ও গৃহিণী দীপ্তি রাণী দেবী দম্পতির ছেলে মাঙ্গাল।

তিনি পড়ালেখা করছেন সিলেটের শাহী ঈদগাহের স্কলার্সহোমে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সামনের বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবেন তিনি। স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর আগেই কিশোর মাঙ্গাল পেরিয়ে গেছেন দেশের অন্য ব্যাডমিন্টন তারকাদের।

বাংলাদেশের ব্যাডমিন্টনে সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট সামার ওপেনে (র‌্যাংকিং) একক ইভেন্টে মাঙ্গালের অবস্থান দ্বিতীয় স্থানে। আপন চাচাতো ভাইয়ের হাতে তাকে পরাজিত হতে হয়েছে। দেশের ব্যাডমিন্টনের অন্যতম এ প্রতিযোগিতাটি বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছরই দেশব্যাপী বিভিন্ন ইনডোরে নিয়মিত বসছে।

চলতি সেপ্টেম্বরে ঢাকাতে সম্পন্ন হয়ে গেলো এবারের আসর। বিভিন্ন প্রান্তের শাটলারগণ তাদের ক্রীড়ানৈপূণ্য প্রদর্শন করেন এখানে। গত কয়েকবছর ধরে দেশের শীর্ষ এই ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে দেশের উত্তরপূর্ব জনপদ সিলেটের দাপুটে অবস্থান। সেই ধারাবাহিতা এবারও ধরে রেখেছেন সিলেটের ব্যাডমিন্টন নক্ষত্ররা।

এককে চ্যাম্পিয়ন ও রানার আপ দু’জনই সিলেটের ঘরের ছেলে। এর আগে আমরা পাঠকদের জানিয়েছি চ্যাম্পিয়ন গৌরবের গৌরবগাঁথার গল্প। আজ জানাবো রানার আপ মাঙ্গাল সিংহের কথা। সামার ওপেন টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন ও রানার আপ দু’জন সিলেটে ফিরেন একসাথে। ফিরেই তারা মুখোমুখি হয়েছিলেন এই প্রতিবেদকের।

মাঙ্গাল বলছিলেন, তার বাবা নিজেও একজন ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার ছিলেন। আর আপন বড় ভাই নোঙ্গাল একসময় দেশের র‌্যাংকিংয়ে তিন নম্বরে ছিলেন। বড়ভাইয়ের সাথে রিকাবীবাজারে মোহাম্মদ আলী জিমনেশিয়াম ইনডোরে ব্যাডমিন্টন প্রাকটিসে যেতেন তিনি। তখন তাকে কেউ তেমন পাত্তা দিতো না। সকলেই নোঙ্গালের কদর করতো; নোঙ্গালকে গুরুত্ব দিতো। এতে বেশ হিংসে লাগতো মাঙ্গালের। তাই তিনি নিজে জেদের বশে ব্যাডমিন্টনে নাম লেখান। অদম্য ইচ্ছা আর দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মাঙ্গাল শুরু করেন প্রাকটিস। এরপর তিনি বুঝতে পারলেন ব্যাডমিন্টনই তার আসল ঠিকানা। এখানেই তিনি নিজেকে মেলে ধরতে পারবেন।

২০১০-১১ সালের দিকে সিলেট ব্যাডমিন্টন একাডেমিতে যুক্ত হন ছোট্ট মাঙ্গাল। কোচ শিব্বির আহমদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর আন্তরিকতায় তিল তিল করে নিজেকে তৈরি করেন মাঙ্গাল। সকালে স্কুল, দুপুরে স্যারের বাসা, পরে হালকা বিশ্রাম। সন্ধ্যায় পড়ালেখা। এরপর রাতে প্রাকটিস। এভাবেই চলতে লাগলো মাঙ্গালের দিনযাপন। নিত্যদিনের সূচি পালন করতে কষ্ট লাগলেও নিজেকে প্রমাণ করতে মাঙ্গাল সকল কষ্ট মেনে নিয়েছেন। নিজের প্রিয় খেলা ফুটবল আর ভবিষ্যতে ম্যাকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নে বুকে নিয়ে পথচলা মাঙ্গাল এখন দেশের দ্বিতীয় সেরা শাটলার। তার হাতের যাদুদে বুদ হয়ে যান অনেকেই।

নিজের এমন অবস্থানে আসার পিছনে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন মাঙ্গালের বড় বোন আতিয়া মাইবাম। আতিয়া নিজেও চার চারবার নিজের কৃতিত্বের জন্য অর্জন করেছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। পড়ালেখা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আতিয়ার আঁকা ছবির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও অর্জন করেছেন পুরস্কার। বোনের এমন সেরা হওয়া আর পুরস্কার পাওয়া অনুপ্রেরিত করেছে মাঙ্গালকে। আতিয়া সরাসরিও নিজের ভাইকে বুঝাতেন- ‘তুমি যদি বড় কিছু হও তবে মানুষ তোমাকে শ্রদ্ধা করবে। সম্মান করবে। ভালোবাসবে।’ বোনের এমন উৎসাহে আমি ব্যাডমিন্টনের পিছনে লেগে ছিলেন মাঙ্গাল। অবশেষে সফলতা ধরা দিল।

২০১১ সালে মাঙ্গালের বয়স তখন বারো। বাংলাদেশ শিশু একডেমি আয়োজিত বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এটিই তার জীবনের প্রথম জাতীয় কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া। সারাদেশের ১২০ জন প্লেয়ারকে পিছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন মাঙ্গাল। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে মাঙ্গাল দেশের হয়ে লড়েছেন বিদেশের মাটিতেও।

২০১৭ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে প্রি-কোয়ার্টারে ভারতে প্লেয়ারের কাছে হেরে বিদেয় নিতে হয় মাঙ্গালকে। কলকাতা, পুনেতে আন্তর্জাতিক জুনিয়র অনুর্ধ্ব-১৯ প্রতিযোগিতায় দেশের হয়ে লড়েছেন মাঙ্গাল।

চলতি বছরের জুলাইতে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত জুনিয়র এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে যাওয়ার কথা ছিল মাঙ্গালের। কিন্তু পরীক্ষা থাকার কারণে তার বদলে চাচাতো ভাই গৌরবকে পাঠানো হয়। প্রি কোয়ার্টারে গিয়ে হার মানতে হয়েছে গৌরবকে। একই টুর্নামেন্টে অংশ নিতে দেশের হয়ে ১ অক্টোবর গৌরবের সাথে মাঙ্গালও রওয়ানা দেবেন মায়ানমারে।

শুধু জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ নয় দেশের বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত টুর্নামেন্টেও গৌরবের পথ ধরে বাজিমাত করেছেন স্কুল পড়ুয়া কিশোর মাঙ্গাল। বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট কাউন্সিলর আজাদ কাপ ব্যাডমিন্টনের শুরু থেকে সবক\\\'টি আয়োজনে চাচাতো ভাই গৌরবের সাথে জুটি হয়ে দারুণ খেলেছেন মাঙ্গালও।

গত ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকার শহীদ তাজ উদ্দিন ইনডোর স্টেডিয়ামে সামার অপেন (র‌্যাংকিং) ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট’১৮ শুরু হয়েছিল। ২৪ সেপ্টেম্বর টুর্নামেন্টের গ্র্যান্ড ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। এককের গ্র্যান্ড ফাইনালে মুখোমুখি মাঙ্গালকে র‌্যাকেট হাতে দাঁড়াতে আপন চাচাতো ভাই গৌরবের মুখোমুখি। বয়সে এক বছরের ছোট সে ভাইয়ের কাছে শিরোপা ছেড়ে দিতে হয় মাঙ্গালকে। তারা দু’জনই এখন সিলেট ব্যাডমিন্টন হাউসের খেলোয়াড়। এই একাডেমির পরিচালক ও কোচের দায়িত্বে আছেন সাবেক ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন এনামুল হক।

মাঙ্গাল নিজের অর্জনের বড় অংশ দিতে চাইলেন নিজের পরিবারের সদস্যদের। বললেন বোনের প্রেরণা আর বাবা, মা ও ভাই নোঙ্গালের উৎসাহ না পেলে তিনি হয়তো ফুটবলেই নিজেকে জড়িয়ে নিতেন। পাশাপাশি নিজের সাবেক কোচ শিব্বির আহমদ ও সাবেক ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন এনামুল হকের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলেন গৌরব। এছাড়া সিলেটের ব্যাডমিন্টনে সিনিয়র প্লেয়ারদের উৎসাহ আর অনুপ্রেরণাও তার সাফল্যে প্রাপ্তিতে ভূমিকা রেখেছে।

দেশসেরা হওয়ার পর ঢাকা থেকে সিলেট ফিরে আলাপচারিতায় ছোটভাই গৌরবের সাথে তিনিও জানিয়েছেন তার স্বপ্নের কথা। দেশের পতাকা নিয়ে একাধিকবার বিদেশের মাটিতে গেলেও আগামীতে নিজের ভাই গৌরবকে সাথে নিয়ে অলিম্পিকে দেশের হয়ে লড়তে চান তিনি। স্বর্ণপদক এনে দিতে চান দেশের ব্যাডমিন্টনে। এখন পর্যন্ত দেশের হয়ে অলিম্পিক ব্যাডমিন্টনে কেউ অংশ নেয়ার সুযোগ পাননি। বাছাইপর্ব থেকেই ছিটকে গেছেন প্লেয়াররা।

মাঙ্গালের সাফল্যের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ সালের দিকে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপের ডাবলসে শিরোপা অর্জন করেছেন তিনি ও তাঁর চাচাতো ভাই গৌরব। চট্টগ্রামের শিবগাত-রিয়াজ জুটিকে হারিয়ে সেই খ্যাতি পান মাঙ্গাল-গৌরব জুটি। পরেরবার একই চ্যাম্পিয়নশিপে শিবগাত-আকিব জুটির কাছে হেরে রানার্স আপ হন তারা দুই ভাই।

পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যাডমিন্টন প্রাকটিস নিয়মিত করা কষ্টসাধ্য হলেও মানিয়ে নিয়েছেন তিনি। এখন তার টার্গেট দেশের মাটিতে সেরাটা ধরে রেখে বিশ্ব মানচিত্রে লাল-সবুজের পতাকাকে মেলে ধরা। নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কলার্সহোম’র প্রিন্সিপাল জোবায়ের সিদ্দিকীর প্রতিও মাঙ্গাল জানালেন গভীর কৃতজ্ঞতা। বললেন- ‘স্যার আমাকে সবসময় সহযোগিতা করেছেন। যখনই বিভিন্ন স্থানে খেলতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়তো স্যার আমাকে ছুটি দিতেন। এজন্য আমি আমি আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল ও অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে কৃতজ্ঞ।’

সিলেটের ব্যাডমিন্টন নিয়ে মাঙ্গাল জানালেন নিজের দুঃখের কথা। তিনি বলেন, সিলেটের ব্যাডমিন্টন প্লেয়াররা বিশ্বের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে দেশকে এনে দিয়েছেন সম্মান। দেশের র‌্যাংকিংয়েও এখানকার প্লেয়ারদের অবস্থান শীর্ষে। কিন্তু তারা যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত। তিনি এ ব্যাপারে সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্বশীলদের সহযোগিতা চেয়েছেন।

পাশাপাশি বিভাগীয় শহর সিলেটে আরোও ব্যাডমিন্টন ইনডোর স্থাপনের দাবি তার। যে দু’টি ইনডোর রয়েছে এগুলো পুরোপুরি ব্যাডমিন্টনের কাছে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন তিনি। ইনডোরগুলোতে কিছুদিন পরপর বিভিন্ন ধরনের সরকারী ও বেসরকারী মেলা আয়োজন প্লেয়ারদের প্রাকটিসে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ করেন তিনি।

গৌরবের মতো মাঙ্গালও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ও ক্রীড়া সংগঠক আজাদুর রহমান আজাদকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সিলেটের ব্যাডমিন্টন প্লেয়ারদের উন্নয়নে আজাদ বিশাল ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। এটা নিঃসন্দেহে অনুকরণীয়।

ইনডোর বিষয়ে মাঙ্গাল আরোও বললেন, সিলেট বিভাগের ৪ টি জেলার মধ্যে মৌলভীবাজার জেলাতে নতুন একটি ইনডোর করা হয়েছে। কিন্তু সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে কোন ইনডোর নাই। একারণে সেখানকার প্লেয়ারদেরকেও প্রাকটিস করতে সিলেটে আসতে হয়। উপজেলার প্লেয়ারদের প্রাকটিসের কারণে আসতে হয় সিলেট নগরে।

জেলা শহরগুলোতে ইনডোর স্থাপনের পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়েও ইনডোর স্থাপন করা প্রয়োজন বলে তিনি বলেন। এর মাধ্যমে দেশের ব্যাডমিন্টন অনেক এগিয়ে যেতে পারে। বের হয়ে আসবে আরোও ভালো ভালো খেলোয়াড়।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২8 সেপ্টেম্বর ২০১৮/শাদিআচৌ/এমইউএ

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন