আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

সিলেটে ভূমি আত্মসাতের চেষ্টা, ব্যবস্থা নেয়া হয়নি অপরাধীদের বিরুদ্ধে

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৫-১৫ ১৪:৫০:৫৮

ফাইল ছবি

আকাশ চৌধুরী :: স্মারক জালিয়াতির মাধ্যমে ন্যাশনাল টি কোম্পানির ২০০ কোটি টাকার ভূমি আত্মসাৎ চেষ্টাকরী চক্রের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেয়ার ৩ মাসেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। ওই আদেশের পর শুধু জালিয়াত চক্রের নামীয় নামজারি বাতিল করে জেলা প্রশাসন। তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ায় কর্মকর্তাদের সময়ক্ষেপণের কারণে জালিয়াত চক্র আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

তারা জেলা প্রশাসনের নামজারি বাতিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজেদের জালিয়াতির কাগজ বৈধ হিসেবে জায়েজ করতে অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। এ জন্য সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাঁপ করছে এ চক্র।

২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয়ের ৩১.০০.০০০০.০৪৩.৬৮.০০৪.১৫.১৪৯ নং স্মারকটি জাল করে সরকারি মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির লাক্কাতুরা মৌজার ২৬.১৩ একর জায়গা নিজেদের নামে নামজারি করে নিয়েছিল চক্রটি। বিষয়টি ধরা পড়ার পর চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের আইন অধিশাখা ২-এর সহকারী সচিব মো. রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সিলেটের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়া হয়।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদে ‘ন্যাশনাল টি কোম্পানির ২০০ কোটি টাকার জায়গা ব্যক্তির নামে নামজারি/ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক জালিয়াতি/জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ডিসিকে নির্দেশ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হলে স্থানীয় মহলে হইচই শুরু হয়। অবশ্য এর একদিন আগেই মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী জালিয়াত চক্রের নামীয় নামজারি বাতিল করেন জেলা প্রশাসক ওই সময় জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল হক ‘সংবাদ’কে বলেছিলেন, জালিয়াতির ঘটনাটি সঠিক। চিঠি পাওয়ার পর তারা প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করেন।

জালিয়াতকারীদের নামে ভূমি নামজারি হওয়ার পর ন্যাশনাল টি কোম্পানি নামজারি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বরাবর আপিল করেছিল। তবে উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ ছিল। ১৯ ফেব্রুয়ারি এই স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ জারি হওয়ায় আগের নামজারি বাতিল করে ওই ভূমি ফের ন্যাশনাল টি কোম্পানির নামে ফেরত দেয়া হয়েছে। এমনকি টি কোম্পানির কাছ থেকে নতুন করে খাজনাও নেয়া হয়।

এদিকে ২৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদে এ খবর প্রকাশ হওয়ার পর জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল হক গত ৪ মার্চ বলেন, বিষয়টি স্পর্শকতার। মন্ত্রণালয়, নাকি জেলা প্রশাসনের কেউ স্মারক জালিয়াতি করেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়ার জন্য বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে।

একই দিন সিলেট বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, একজন অফিসারের মাধ্যমে তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য জেলা প্রশাসককে (ডিসি) বলে দেয়া হয়েছে। তবে বিভাগীয় কমিশনার এ তথ্য দেয়ার প্রায় পৌনে দুই মাস পর তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য গত সপ্তাহে একটি চিঠি পৌঁছায় জেলা প্রশাসনে। গত সোমবার এক কর্মকর্তাকে ঘটনার তদন্তে নিয়োগ দেন জেলা প্রশাসক।

ভূমি অফিস সূত্র জানায়, স্মারক জালিয়াতির মাধ্যমে যে দু’জনের নামে ২০০ কোটি টাকার ভূমি নামজারি করা হয়েছিল, তারা হলেন সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের ঘোপাল গ্রামের বশির উদ্দিন চৌধুরীর পুত্র শামসুজ্জামান চৌধুরী ও সৈয়দ আবদুর রশিদের পুত্র সৈয়দ আবদুল হামিদ।

সূত্র জানায়, তাদের নামে নামজারি হলেও এর পেছনে অত্যন্ত প্রভাবশালী চক্র ছাড়াও জড়িত ওই সময়কার জেলা প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা। ফলে শুরু থেকে ঘটনাটি তদন্তে বিব্রতবোধ করছিল জেলা প্রশাসন। তাই মন্ত্রণালয়ের কাউকে দিয়েই এর তদন্তের পক্ষে ছিলেন বর্তমান জেলা প্রশাসক। কিন্তু বিভাগীয় কমিশনার তাকেই তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের নির্দেশ দেন।

যোগাযোগ করা হলে জেলা প্রশাসক বলেন, একজন কর্মকর্তা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছেন। তবে ওই কর্মকর্তার নাম প্রকাশে অপরাগতা প্রকাশ করেন তিনি। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে ঘটনার তদন্ত না হওয়া ও অপরাধীরা আইনের আওতায় না আসায় নতুন করে নিজেদের জালিয়াতি বৈধ করতে ফন্দি শুরু করেছে ওই চক্র। জালিয়াত চক্রের মূল হোতা মো. শামসুজ্জামান চৌধুরী গত ২১ এপ্রিল উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেছেন। এতে ভূমি সচিবসহ ৭ জনকে বিবাদী করা হয়েছে।

অন্য বিবাদীরা হলেন- ভূমি মন্ত্রণালয়ের আইন অধিশাখা ২-এর উপ-সচিব, সিলেট জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), সহকারী কমিশনার (ভূমি), ন্যাশনাল টি কোম্পানির অধীনস্থ লাক্কাতুরা চা বাগানের ব্যবস্থাপক ও কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেড সরকার কর্তৃক বিনিয়োগকৃত একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ও সিলেট সদর উপজেলার আওতাভুক্ত লাক্কাতুড়া চা বাগানটি এর অন্যতম। ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ মালিকানাধীন লাক্কাতুড়া চা বাগানের সমুদয় ভূমি বাগান কর্তৃপক্ষ বৈধভাবে দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করে আসছে। সম্প্রতি বাগান কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, বাগানের অন্তর্ভুক্ত জেলা সিলেট, উপজেলা সদর, মৌজা লাক্কাতুরা টি গার্ডেন, জেএল নং-৭৫, খতিয়ান-২ ও ৩, দাগ নং-৯৮৪, ৯৮৮, ৯৪৪, ৯৪৫, ৯৪৬ ও ৯৮৭-এর মোট ২৬.১৩ একর ভূমি গোপনে একটি পক্ষের নামে নামজারি হয়ে গেছে।

ন্যাশনাল টি কোম্পানি সূত্র জানায়, বিবিধ মোকদ্দমা নং-৬৫/২০১৮ মোতাবেক জনৈক শামছুজ্জামান চৌধুরীসহ কয়েকজনের নামে অবৈধ, বেআইনি ও যোগসাজশে ভূমি নামজারির আদেশ দেন তৎকালীন সিলেট সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি)।

সূত্র জানায়, রিট পিটিশন নম্বর ১০৮২৮/২০১৬-এর ২৩/১০/২০১৬ তারিখের ইস্যুকৃত রুল বাস্তবায়নের জন্য স্বত্ব ২৬/৬৯ নম্বর মোকদ্দমার রায় ডিক্রি বলে ভূমি মন্ত্রণালয় আইন অধিশাখা ২-এর ০৭/০২/২০১৭ তারিখের ৩১.০০.০০০০.০৪৩.৬৮.০০৪.১৫.১৪৯ নম্বর স্মারকে জেলা প্রশাসক সিলেটকে মোকদ্দমা নং ২৬/৬৯-এর প্রদত্ত রায় ডিক্রির আলোকে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিগত ০২/১০/২০১৩ তারিখের ৩১.০০.০০০০.০৪৩.৬৭.০০৩.১২/৪৮৯ নং স্মারকে ইস্যুকৃত পত্রের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য রেকর্ড সংশোধনপূর্বক আবেদনকারীর অনুকূলে নামজারি/জমাভাগক্রমে সরকারি রাজস্ব আদায় করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হয়।

উল্লেখিত এ চিঠিটি ছিল সম্পূর্ণ জাল। ওই সময়কার জেলা প্রশাসক ছিলেন রাহাত আনোয়ার। তিনি চিঠিটি সঠিক কিনা, তা যাচাই-বাছাই না করে ওই পত্রের প্রদত্ত নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় (রাজস্ব শাখা) সিলেটের ০৬/০২/২০১৮ তারিখের ০৫.৪৬.৯১০০.০০৮.৪৫.০১৪.৯৯.৩৪৫ (২) নং স্মারকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সাহকারী কমিশনার (ভূমি) সিলেট সদরকে নির্দেশনা প্রদান করেন।

এ নির্দেশনার পর সহকারী কমিশনার (ভূমি) ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনাধীন লাক্কাতুরা চা বাগানকে কোনরূপ নোটিশ না দিয়ে প্রচলিত নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে গোপনে চা বাগানের স্বত্ব দখলীয় ভূমি জালিয়াত চক্রের নামে নামজারি করে দেন। ২৬.১৩ একর নামজারিকৃত ভূমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

ন্যাশনাল টি কোম্পানির অভিযোগ, বাগান কর্তৃপক্ষকে কোন নোটিশ না দিয়ে দেওয়ানি মোকদ্দমায় প্রদত্ত ১৯/১১/১৯৭০-এর ডিক্রির ৪৭ বছর পর সম্পূর্ণ অবৈধ, বেআইনি ও যোগসাজশে নামজারি কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। বিষয়টি গত বছরের ১৯ নভেম্বর ভূমি সচিবকে অবহিত করে বাগান কর্তৃপক্ষ। এরপরই স্মারক জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।


সৌজন্যে-সংবাদ


সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৫ মে ২০১৯/এসি/এসডি

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন