আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

নবীগঞ্জে ধান-চাল ক্রয়ে চলছে ব্যাপক অনিয়ম, ক্ষোভ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৬-১৯ ২৩:৪৪:১৯

এস এম আমীর হামজা, নবীগঞ্জ :: হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় সরকারের সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ও চাল ক্রয়ে চলছে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। উপজেলা খাদ্য অধিদপ্তর ও কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের ঠেলাঠেলিতে অনিয়ম হচ্ছে। তারা দায়ভার এড়িয়ে একে অপরের উপর দোষ চাপাচ্ছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত কৃষক। কার কাছে গেলে ন্যায্য অধিকার পাবেন তাদের।

আবার দেখা গেছে অনেক গ্রামকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। একই পরিবারের ৫ জন থেকে ৭ জনকে  কৃষক হিসাবে দেখানো হয়েছে। চেয়ারম্যান মেম্বারসহ তাদের আত্মীয় স্বজন বেশি রয়েছেন তালিকায়। কৃষক নয়, এমন ব্যক্তির নামে তালিকা ভরপুর।

তালিকায় রয়েছে প্রবাসীদের নামও। পেশায় কৃষক না হলেও কৃষক সেজে টনপ্রতি ৩ হাজার টাকা করে উৎকোচ দিচ্ছেন খাদ্য কর্মকর্তাকে। কৃষকের এই তালিকা নিয়ে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে উপজেলার সর্বত্র।

মাসখানেক ধরে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করা হলেও ৫৩৮ মে. টনের মধ্যে নেয়া হয়েছে মাত্র ১৭০ মেট্রিক টন। টন প্রতি খাদ্য গোদামের কর্মকর্তাকে চাহিদা মতো টাকা না দেয়ায় এবং নানা অজুহাতের কারণ দেখিয়ে কৃষকদের ধান ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।

আবার অনেক কৃষকের ধান গুদাম এলাকায় দিনের পর দিন মাপের অজুহাতে  জমা পড়ে আছে।  সিন্ডিকেট ও প্রভাবশালী নেতার মাধ্যমে ক্রয় চলছে। এতে করে কৃষকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।

কৃষককে ধানের ন্যায্যমূল্য দেওয়ার সরকারী উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে। একই পরিবারে ৫-৭ জনের নাম এবং চেয়ারম্যান ও স্থানীয় ইউপি সদস্যদের নিজের নাম, গ্রাম ও আত্মীয় স্বজনদের প্রধান্য দিয়েই তৈরি করা হয় তালিকা। এনিয়ে নবীগঞ্জে সুশীল সমাজের মধ্যে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

এবিষয়ে জানতে সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে গেলে এবং কথা বললেও কেউ দায়ভার নিতে চাচ্ছেন না। কর্মকর্তারা একে অপরকে দোষারূপ করছেন। ধান সংগ্রহ অভিযানের শুরু থেকেই প্রভাবশালীদের কব্জায় চলে যায় সংগ্রহ অভিযান। ওই সব নেতা ও ব্যবসায়ী রাতারাতি হয়ে উঠেছেন কৃষক। তারা কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে সরকারি গুদামে বেশি দামে বিক্রি করছেন।

তাই সরকারের ধান কেনায় কৃষক নয়, জনপ্রতিনিধি ও নেতারাই বেশি লাভবান হচ্ছেন। অনেকেই মনে করেন, ধান-চাল সংগ্রহ নীতিমালা পরিবর্তন না হলে সরকারের এ সহায়তা কৃষকের কাছে পৌঁছাবে না। ধান সংগ্রহ কার্যক্রমের পূর্বে একটি পৌরসভাসহ ১৩টি ইউনিয়নে পৃথকভাবে নামের তালিকায় তৈরি করা হয়েছে।

এ বছর ধান চাষ করে শ্রমিক সংকটে বিপাকে পড়েন কৃষকরা। ফসলি জমিতে পানি ও ধানের মূল্য কম হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। অনেকেই তার জমিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে এর প্রতিবাদ ও করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমান সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

ধানের দরপতন ঠেকাতে ২৬ মে থেকে সরকার নির্ধারিত প্রতি মণ ধান ১ হাজার ৪০ টাকা দরে ধান-চাল কেনার কার্যক্রম শুরু হয়। চলবে ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এবার বোরো মৌসুুমে সাড়ে ১২ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে। 

কার্যক্রম উদ্বোধনের  পর নবীগঞ্জের একটি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়নের কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। এরপূর্বে প্রকৃত কৃষকদের নাম না রেখে প্রভাবশালী নেতা, ব্যবসায়ী, ইউপি সদস্য, ও সংশ্লীষ্ট দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের জোগসাজশে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নবীগঞ্জ পৌরসভা ও উপজেলা ১৩টি ইউনিয়নে একটি করে আলাদা আলাদা তালিকা করা হয়। এ তালিকায় বেশির ভাগই লোকই কৃষক নয়।

জানা গেছে, বাজারে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। নেতারা ইউপি সদস্যসহ সঙ্ঘবদ্ধভাবে সিন্ডিকেট তৈরি করে কৃষকদের কাছ থেকে ওই দামে ধান কিনছেন। সেই ধান সরকারি গুদামে সরবরাহ করে তারা প্রতি মণে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

নবীগঞ্জ খাদ্য গোদাম অফিস সূত্রে জানা যায়, নবীগঞ্জ উপজেলা ও পৌরসভা মিলে ৫৩৮ মেট্রিকটন ধান সংগ্রহের কথা রয়েছে। তবে ভাল মানের ধান হতে হবে। যাচাই বাছাই শেষে ধানের মান ভাল না হলে কেনা যাবেনা। এখন পর্যন্ত ধান সংগ্রহ করা হয়েছে ১৭০ মে. টন। তাদের কথা অনুযায়ী এখন ও আর ৩৬৮ মে. টন ধান সংগ্রহের কাজ বাকি রয়েছে।

এ নিয়ে নবীগঞ্জ উপজেলা সহকারী (ভুমি) আতাউল গনি ওসমানীকে আহবায়ক করে ,এবং উপজেলা কৃষি অফিসার, উপজেলা প্রজিব কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা প্রকৌশল কে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) আতাউল গনি ওসমানী বলেন- আমরা তদন্ত করে বিষয়টি দেখছি যাদি কেউ অনিয়ম করে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে

শিবলু মিয়া নামে এক কৃষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রভাবশালী একটি মহলের ছত্রছায়ায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাহলে অনিয়ম দুর্নীতি কেন? তিনি এক সপ্তাহ ধরে ধান নিয়ে আসলেও তার ধান নেয়া হচ্ছেনা। আবার প্রভাবশালীরা বিভিন্ন মাধ্যমে সাথে সাথে ধান দিয়ে যাচ্ছে।

তালিকাভুক্ত কৃষক কামাল মিয়া জানান, খাদ্য কর্মকর্তার কথা অনুযায়ী গত এক সপ্তাহ যাবত আমার ধান খাদ্য গুদামে পড়ে রয়েছে, কিন্তু মাফ হচ্ছেনা এবং আমার ধান নেয়া হচ্ছেনা।

আনছার মিয়া নামে এক কৃষক জানান, কৃষি কর্মকর্তা ও মেম্বারকে টাকা না দেওয়ায় আমিসহ ৩ জনের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে আমরা এখন ধান বিক্রি করতে পারছিনা। সরকার কার জন্য ধানের দাম বাড়াইলো?

এ ব্যাপারে জানতে খাদ্য গুদাম ইনচার্জ আহসান হাবিব বলেন, আমাদের  কোন দুর্নীতি হচ্ছে না, আমরা কৃষকের তালিকা মোতাবেক ধান নিচ্ছি, কোন অনিয়ম হলে কৃষি অফিস করেছে, তাদের তালিকায় যদি কোন কৃষক বাদ পড়ে আমাদের কিছু করার নেই, আবার কোন অকৃষক যদি তালিকায় ডুকে আমাদের কিছু করার নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন আমরা কারো কাছ থেকে টাকা নেই নাই। যারা এসব অভিযোগ করেছে সেটা সঠিক নয়।

নবীগঞ্জ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক গৌরি পদ বলেন, নবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তারাই এব্যাপারে ভাল বলতে পারবেন। কারন তাদের মাধ্যমেই এ তালিকা করা হয়েছে। আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কৃষক আসলে সেই ধান সংগ্রহ করি আবার অনেকে ধান রেখে চলে যান।

এব্যাপারে জানতে চাইলে নবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, এ কে এম মাকসুদুল আলম বলেন, আমরা স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারদের সহযোগীতায় এই কৃষকদের তালিকা তৈরি করেছি।

নবীগঞ্জ ধান-চাল সংগ্রহ কমিটির উপদেষ্টা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক চৌধুরী সেলিম বলেন, যদি তালিকায় কোনো প্রবাসীর নাম দেয়া হয় এবং জনপ্রতিনিধির নাম পাওয়া যায় তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ ১৯ জুন ২০১৯/এসএআর/এক

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন