আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

সিলেটে চিকিৎসা না পেয়ে ৫ দিনে প্রাণ গেল ৩ জনের

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৬-০৬ ০০:৩৭:৪১

জুনেদ আহমদ চৌধুরী :: করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়ে সিলেটের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। জটিল কোন রোগী ভর্তি করছে না তারা। করোনার আগ পর্যন্ত এসব ক্লিনিক-হাসপাতাগুলো রোগীদের জামাই-আদর করে ভর্তি করতেও দেখা যেত। বর্তমানে এর ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে সিলেটে। মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে সিলেটের বিভিন্ন নামিদামী ক্লিনিক-হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সর্বশেষ, আজ শুক্রবার সিলেটের বন্দর বাজারের এক ব্যবসায়ী নগরীর ৪টি হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন। আজ সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ইকবাল হোসেন খোকা নামের ওই ব্যবসায়ীর বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ৪টি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে ভর্তি হন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে যাওয়ার পর তিনি মৃত্যুর কুলে ঢলে পড়েন।

এরআগে, গত ৩১ মে দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভোগা নগরীর কাজিরবাজার মোগলটুলা এলাকার বাসিন্দা এক নারী অসুস্থ হলে সিলেটের ৬টি বেসরকারী হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা পাননি। পরে ওসমানী হাসপাতালে যাওয়ার পথে তারও মৃত্যু হয়। একই দিনে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে স্ট্রোক করে সিলেটে আসা এক রোগী ৭টি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান।

জানা গেছে, গত রবিবার (৩১ মে) সিলেট নগরীর কাজিরবাজার মোগলটুলা এলাকার বাসিন্দা এক নারী (৬৩) বিগত ৩০-৩৫ বছর ধরে অ্যাজমা রোগে ভুগছিলেন। ওই রাতেই রোগীকে প্রথমে সোবহানীঘাটস্থ আল-হারামাইন হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে জরুরি বিভাগ তাকে চিকিৎসা সেবা না দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে রেখেই আইসিইউ নাই বলে অন্য কোন হাসপাতালে যেতে বলে। পথিমধ্যে আরেকটি বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসা না দিয়ে রোগীকে নর্থ ইস্ট মেডিকেলে নেয়ার পরামর্শ দেন। নর্থ ইস্ট হাসপাতাল যাওয়ার পর অক্সিজেন সুবিধা নেই বলে ওখানেও তাকে রাখা হয়নি। রোগীর স্বজনরা তাকে সোবহানীঘাটস্থ মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসলে তারা জানায় এই হাসপাতালে বয়স্ক রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় না। পরে হাসপাতাল থেকে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নেন রোগীর স্বজনরা। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীকে সেখান থেকে নিয়ে আসা হয় সিলেট নগরীর তালতলাস্থ পার্ক ভিউ হাসপাতালে, সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা রোগীকে রাগীব-রাবেয়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী রাগীব-রাবেয়া হাসপাতালে নিয়ে আসার পর রোগীকে এক্স-রে ও অন্যান্য পর্যবেক্ষণের পর ওসমানী হাসপাতালে দ্রুত প্রেরণের জন্য বলেন। তখন রোগী প্রচন্ড বুকের ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলেন।

বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে শংকটাপন্ন রোগীকে নিয়ে ওসমানী হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হয় অ্যাম্বুলেন্স। রাত আড়াইটার দিকে ওসমানী হাসপাতালের গেইটে পৌঁছামাত্র ওই নারী মারা যান।

এদিকে একই দিন সন্ধ্যায় বাথরুমের ভেতর স্ট্রোক করেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালিঘাট রোডের ৭০ বছর বয়স্ক এক নারী। প্রথমে স্থানীয় চিকিৎসক তাকে দেখে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আইসিইউতে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। তখন তার স্বজনরা সাথে সাথে রোগীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে মৌলভীবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু মৌলভীবাজারের কোন হাসপাতালে আইসিইউ সেবা না থাকায় তারা রোগীকে অক্সিজেন দিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হন।

করোনা পরিস্থিতির মধ্যে শ্রীমঙ্গল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে এসে ওই নারীকে নিয়ে সিলেটের একের পর এক হাসপাতাল ঘুরতে হয়েছে পরিবার পরিজনের। একে একে করে ৭টি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে এই রোগীর ঠাই হয়নি কোথাও।

প্রথমে রোগীর স্বজনরা সিলেটে প্রবেশ করেই রোগীকে নিয়ে দক্ষিণ সুরমার নর্থ ইস্ট হাসপাতালে যান। সেখানে বার বার বলা সত্ত্বেও কোন চিকিৎসক রোগীর কাছে আসেননি। এমনকি রোগীর অক্সিজেন শেষ হয়ে যাচ্ছে বললেও তারা সাড়া দেননি।

রোগীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে দেখে তারা নর্থ ইস্ট হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একে একে সিলেট নগরীর ওয়েসিস হসপিটাল, আল হারামাইন হসপিটাল, ইবনেসিনা হাসাপাতাল, মাউন্ট এডোরা, উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হসপিটাল এবং নুরজাহান হসপিটালে নিয়ে যান। কিন্তু কোনটিতেই রোগীকে ভর্তি করা দূরের কথা কোন চিকিৎসক রোগীর কাছেও আসেননি।

৭টি হাসপাতাল ঘুরে সঙ্কটাপন্ন রোগীকে নিয়ে ওসমানী হাসপাতালের দিকে রওনা হয় অ্যাম্বুলেন্স। রাত সোয়া ১টার দিকে ওসমানী হাসপাতালের গেইটে পৌঁছামাত্র ওই নারী মারা যান।

সর্বশেষ শুক্রবার নগরীর ৪টি হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন বন্দরবাজার এলাকার ব্যবসায়ী নগরীর কুমারপাড়ার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন খোকা (৫৫)।

জানা গেছে, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মারা যাওয়া ওই ব্যবসায়ীর বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। প্রথমেই রোগীর স্বজনরা সোবাহানীঘাট এলাকার একটি হাসাপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণ সুরমার নর্থ ইস্ট হাসপাতালে। সেখানে গেলে কর্তৃপক্ষ জানান তাদের হাসপাতালে সিট নেই, রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়।

পরবর্তীতে শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে যাওয়া হয়। মারা যাওয়া ব্যবসায়ীর স্বজনদের অভিযোগ, শামসুদ্দিন হাসপাতাল গিয়ে তারা সবকিছু বন্ধ পান। ১০-১৫ মিনিট পরে এক নিরাপত্তাকর্মী এসে জানান হাসপাতালের সবাই ঘুমে। অন্য কোথাও রোগীকে নিয়ে যেতে। তখন তারা সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হন। সেখানে জরুরী বিভাগে যাওয়ার পর তারা সিসিইতে নিয়ে একটি ইসিজি করেন। এরপরই হাসপাতালের ইর্মাজেন্সিতে কর্তব্যরত চিকিৎসক ওই ব্যবসায়ীকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদেরও চিকিৎসা দেয়ার সরকারি নির্দেশনা থাকার পরও শংকটাপন্ন অবস্থায় সিলেটের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ভর্তি না করায় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে, দুটি ঘটনার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোকে সতর্ক করে চিঠি দেয়া হলেও আবারো ঘটল প্রায় একই ধরণের ঘটনা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, সিলেটের ৩টি ঘটনা শুনেছি। কেউ আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেনি। লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এছাড়া তিনি রোগীদের প্রথমেই ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করার অনুরোধ করেন।

হাসপাতালে ভর্তি না করা প্রসঙ্গে নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী সিলেটভিউকে জানান, বিষয়টি আমার জানা নেই। তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। কারা এসব রোগী ভর্তি করেনি আগামিকাল গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখব। তবে তিনি উল্লেখ করেন, অনেক ডাক্তার-নার্সরা করোনা কিংবা কোন জটিল রোগী নিয়ে এখন মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। আমারা তাদের নিয়ে ইতিমধ্যে কাউন্সিলিং শুরু করেছি। যাতে তারা মানসিকভাবে আরো শক্ত হয়।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/৬ জুন ২০২০/জুনেদ

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন