আজ বুধবার, ০৮ মে ২০২৪ ইং

জেল সুপারের পরিচয়ে যেভাবে প্রতারণার শিকার হন হাজতিদের স্বজনরা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৯-১৯ ২২:৩১:২১

কাজল সরকার, হবিগঞ্জ প্রতিনিধি :: হবিগঞ্জে জেল সুপার সেজে কারাগারে থাকা আসামি ও কয়েদিদের পরিবারের সাথে প্রতারণা করছে একটি চক্র। চক্রটি প্রতারণার মাধ্যমে কারাগারে থাকা আসামি ও কয়েদিদের স্বজনদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রতারক চক্রটিকে ধরতে হবিগঞ্জ সদর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছে জেল কর্তৃপক্ষ। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষতে পুলিশ ইতোমধ্যেই চক্রটিকে ধরতে কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে জানিয়েছে সদর থানা পুলিশ।

জানা যায়, কয়েক দিন ধরে হবিগঞ্জে একটি প্রতারক চক্র মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এই প্রতারণা শুরু করেছে। প্রথম অবস্থায় তারা বেছে নিয়েছে হবিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন আইনজীবিদের। তারা আইনজীবিদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে। পরে নিজেকে জেলা সুপার পরিরচয় দিয়ে ওই আইনজীবির কোন আসামী কারাগারে আছে কি-না জানতে চায়। সরল মনে আইনজীবি তার আসামী কারাগারে আছে জানালে চক্রটি বলে- ‘আপনার আসামী জেলের স্টাফদের সাথে মারামারি করেছে। তাই আমরা তাকে আরেকটি মামলা দিয়ে কুমিল্লা পাঠিয়ে দেব। আপনে তার পরিবারের স্বজনদেরকে বলেন আমার ফোন নম্বরে যোগাযোগ করতে।’

আসামীর স্বজনরা ফোন দিলে চক্রটি তাদেরকে জেল সুপার পরিচয় দিয়ে একই কথা জানায়। আসামীর স্বজনরা এর থেকে পরিত্রাণের উপায় জানতে চাইলে চক্রটি ৪ হাজার ৮শ’ টাকা দাবি করে। এবং বলে ওই টাকা বিকাশে দিতে হবে। নিজের আপনজনের সুবিধার কথা বিবেচনা করে অনেকেই ৪ হাজার ৮শ’ টাকা ও বিকাশের খরচসহ ৫ হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছেন প্রতারক চক্রের বিকাশ নাম্বারে। এমনকি চক্রটি জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) সিরাজুল ইসলামের সাথে প্রতারণার জাল বুনে। কিন্তু পিপির দুরদর্শিতার কারণে তারা ব্যর্থ হয়।

তবে এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন জেলার অন্তত ১৫-২০ জন। পরে তারা বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য জেলা কারাগারে গেলে এমন কোন আলামত পাননি। ভুক্তভোগিদের কাছ থেকে এমন বেশ কয়েকটি অভিযোগ পাওয়ার পর কারা ফটকের সামনে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি টানিয়েছে জেল কর্তৃপক্ষ। এছাড়া যে দুটি ফোন নম্বর দিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে সেই নম্বর দুটি উল্লেখ করে হবিগঞ্জ সদর থানায় লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন জেল সুপার।

এমন প্রতারণা শিকার হয়েছেন জেলার বানিয়াচং উপজেলা উত্তর সাঙ্গর গ্রামের ফারুক হোসেন বেলুর স্ত্রী। গত শনিবার তার স্ত্রীর কাছে তার আইনজীবি ফোন করে একটি নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। বেলুর স্ত্রীর ওই নাম্বারের ফোন দিলে প্রতারক চক্রটি নিজেকে জেল সুপার পরিচয় দিয়ে বলে ‘আপনার স্বামী জেলে স্টাফদের সাথে মারামারি করেছে। তাই আমরা তাকে আরেকটি মামলা দিয়ে কুমিল্লা পাঠিয়ে দেব। আপনার স্বামীকে হবিগঞ্জ কারাগারে রাখতে চাইলে ৪ হাজার ৮শ’ টাকা বিকাশে দিতে হবে। স্বামীকে হবিগঞ্জ কারাগারে রাখতে সাথে সাথে বেলুর স্ত্রী প্রতারক চক্রের দেয়া বিকাশ নাম্বারের ৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। পরে তিনি জেলা কারাগারে এসে বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

একইভাবে প্রতারিত হন আজমিরীগঞ্জ উপজেলার নগর গ্রামের শাহ জাহান মেম্বারের স্ত্রী। তিনিও ওই চক্রটিকে বিকাশে ৫ হাজার টাকা দিয়েছেন।

তবে নিজের দূরদর্ষিতার কারণে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পান শহরের কামড়াপুর এলাকার বাসিন্ধা আব্দুল বারিক। তার ছেলে সাকিবুর রহমান প্রকাশকে কুমিল্লা পাঠানোর কথা বলে চক্রটি ৪ হাজার ৮শ’ টাকা দাবি করে।

এ ব্যাপারে তিনি জানান, সোমবার সন্ধ্যায় আমার প্রতিবেশি ও আমার ছেলের মামলার আইনজীবি আমাকে একটি নম্বর দিয়ে (০১৭৩৯-২২৩০৮০) যোগাযোগ করতে বলেন। আমি ওই নাম্বারে ফোন দিলে একজন লোক নিজেকে জেল সুপার পরিচয় দিয়ে জানান আমার ছেলে জেলে স্টাফদের সাথে মারামারি করেছে। তাকে কুমিল্লা পাঠিয়ে দেয়া হবে। যদি তাকে হবিগঞ্জ কারাগারে রাখতে চান তাহলে বিকাশে ৪ হাজার ৮শ’ টাকা পাঠাতে হবে। তখন আমি বললাম টাকা নিয়ে কারাগারে আসছি। এ কথা বলার পরপরই লোকটি আমাকে গালিগালাজ করতে শুরু করে। পরে আমি কারাগারে গিয়ে জানতে পারি এটি একটি প্রতারক চক্র।’

এ ব্যাপারে সাকিবুর রহমানের আনজীবি এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী জুয়েল বলেন- ‘০১৭৩৯২২৩০৮০ এই নম্বর থেকে সোমবার সন্ধায় আমার কাছে একটা ফোন আসে। একজন লোক নিজেকে জেল সুপার পরিচয় দিয়ে কারাগারে আমার কোন মক্কেল আছে কি না জানতে চায়। পরে তারা আমার মক্কেলের স্বজনের কাছে ওই নম্বরটি দিয়ে যোগাযোগ করতে বলে।

একইভাবে ফোন আসে জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক চৌধুরীর কাছে। এ সময় তিনি এটি প্রতারণা বুঝতে পেরে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এ সময় প্রতারক চক্রের সাথে তার বাকবিতÐা হয়।

এ ব্যাপারে পিপি সিরাজুল হক চৌধুরী বলেন- ‘সকালে আমার একজন সহকর্মী প্রতারক চক্রের বিষয়টি আমাকে বলেন। বিকেলেই আমার কাছে (০১৭৬৫-১৭৭৪০১) নম্বর থেকে এমন একটি ফোন আসে। পরে আমি এটিকে প্রতারক চক্র বুঝতে পেরে বিভিন্ন প্রশ্নের এক পর্যায়ে তার সাথে আমার বাকবিতন্ডা হয়। পরে বিষয়টি আমি জেল সুপারকে অবগত করি। এবং দ্রুত কার্যকরি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেল সুপারকে অনুরোধ করি।’

এ ব্যাপারে জেল সুপার গিয়াস উদ্দিন বলেন- ‘আমার কাছে এমন বেশ কয়েকটি অভিযোগ আসার পর আমরা জেল ফটকে একটি সতর্ককরণ বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দিয়েছি। এছাড়া দুটি নম্বর উল্লেখ করে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে হবিগঞ্জ সদর থানায় একটি লিখিত আবেদন করা হয়েছে। আশা করি দ্রুত প্রতারক চক্রটিকে গ্রেফতার করা হবে।’

কোন প্রতারক নিজেকে জেল কর্তৃপক্ষ পরিচয় দিলে সরাসরি জেল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগযোগ করতে তিনি সকলের প্রতি অনুরোধ জানান।

উল্লেখ্য- মৌলভীবাজার জেলাসহ বিভিন্ন জেলায় এমন প্রতারণা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। চক্রটি হাজার হাজার মানুষের সাথে এমন প্রতারণা কলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

সিলেটভিউ/১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮/ডেস্ক/পিডি

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন