আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

‘হাছন রাজা’ প্রসঙ্গে-

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৩-০৭ ০০:২৯:১৯

শামসুল ইসলাম শামীম :: কাহিনীর শুরু আজ থেকে ১শ’ ৬৫ বছর আগে; অর্থাৎ ১৮৫৪ সাল থেকে। ওই বছরের ২১ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের তেঘরিয়ায় জন্ম নেন অন্যতম এক কালপুরুষ হাছন রাজা; দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী। প্রতাপশালী জমিদার দেওয়ান আলী রাজার তৃতীয় সন্তান হাছন রাজাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে নাটকের দেহসৌষ্ঠব। দেওয়ান আলী রাজার পঞ্চম স্ত্রী হুরমত জাহান বিবির গর্ভে জন্ম নেন আমাদের ‘হাছন’।

কৈশোরেই হাছন রাজাকে জমিদারীর দায়িত্ব নিতে হয়। ফলে ওই বয়সেই ‘নিষিদ্ধ গন্ধম’র প্রতি আকৃষ্ঠ হন কিশোর হাছন। নিজেকে সঁপে দেন ভোগ-বিলাসে। নাটকের কাহিনী এগুতে থাকে এই ধারাবাহিকতায়। সিলেটের থিয়েটার আন্দোলনের অন্যতম ‘যোদ্ধা’ নান্দিক নাট্যদলের অন্যতম একটি সফল প্রযোজনা ‘হাছন রাজা’। খুব সম্ভবত হাছন রাজাই নান্দিকের সবচে’ সফল ও দর্শকনন্দিত মঞ্চকর্ম। সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেটের আয়োজনে একুশের আলোকে নাট্য প্রদর্শনীর দশম দিনে বুধবার সন্ধ্যায় ‘হাছন রাজা’ নিয়ে আবারো মঞ্চারোহন করে নান্দিক। মোস্তাক আহমেদের রচনা ও আমিরুল ইসলাম বাবুর নির্দেশনায় প্রায় ১ঘন্টার এই নাটকটি দর্শক মাতায় একথা বলা যায় নি:সন্দেহে। তবে নাটকের শারীরিক গঠনকে আরো সুশোভিত করতে আরো কিছু যত্নের প্রয়োজন ছিলো বলে মনে হয়। নাটকের কাহিনীতে কিছু ‘প্রশ্নবোধক চিহ্ন’ থেকে গেছে বলে মনে করছেন বোদ্ধা দর্শকরাকূল।

পুরো নাটক জুড়ে হাছন রাজাকে দেওয়ান হাছন রাজা হিসেবেই উল্লেখ করে হয়েছে। নাটকের কোথাও কখনোই হাছনের প্রকৃত নামটি তুলে আনেননি নাট্যকার। হাছনের জন্মের পর তার পিতা দেওয়ান আলী রাজা বৈমাত্রেয় ভাই দেওয়ান ওবেদুর রাজার পরামর্শে তারই নামের সাথে মিল রেখে হাছনের নাম রাখেন দেওয়ান অহিদুর রাজা চৌধুরী। মতান্তরে কোন কোন ঐতিহাসিক হাছন রাজার নাম অহিদুর রেজা বলেও উল্লেখ করেন। সেই অহিদুর রাজা বা রেজা থেকে ‘হাছন রাজা’ নামকরনের পেছনেও বেশ মজার একটি ঘটনা আছে, সেটিও এড়িয়ে গেছেন নাট্যকার। তবে, একথা নি:সন্দেহে বলা চলে নাট্যকার তাঁর সপ্রতিভ চিন্তা-চেতনায় স্বীয় অবস্থানে উৎরে গেছেন। একই ভাবে ‘হাছন রাজা’র নির্দেশক প্রাজ্ঞ নাট্যজন-নাট্য নিদের্শক আমিরুল ইসলাম বাবু তাঁর মেধা ও মননকে যথাযথ ভাবেই কাজে লাগিয়েছেন। তবে নাটকাটি জুড়ে ‘রিহার্সেল’র ঘাটতি ছিলো বললে বোধ করি যেমন বাতুলতা হবেনা তেমনি ভাষার প্রয়োগও ছিলো আঞ্চলিক শুদ্ধ বাংলার মিশ্রণ দোষে দুষ্ঠ!

নাটকের কেন্দ্রিয় চরিত্র ‘হাছন রাজা’ রূপায়নে মাধব কর্মকার উৎরে গেছেন। প্রথম দিকে কিছুটা জড়তা থাকলেও শেষের দিকে এসে মেধাবী এই মঞ্চাভিনেতা দর্শকদের সামনে অত্যন্ত সফল ভাবে নিজেকে উজাড় করে দিতে পেরেছেন। নায়েব ও গোমস্তা চরিত্রের মধ্যে কাহিনীর আলোকে নায়েব চরিত্রটি একটি মৌলিক চরিত্র। হাছন রাজা জমিদারী করলেও সেই জমিদারীর মৌলিক ও নেপথ্য কুশীলব ছিলেন হাছন রাজার মা হুরমত জাহান বিবি। হুরমত জাহান বিবির সামনে দাঁড়িয়ে নায়েব ও গোমস্তার বাদানুবাদ মূলত জমিদারী প্রথাবিরোধী। হাছন রাজা কিশোর বয়সে যখন জমিদারের দায়িত্ব নেন তখন নায়েব বয়সে ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ, এ বিষয়টি রূপসজ্জা সংশ্লিষ্ঠদের মাথায় থাকা উচিৎ ছিলো। তারপরও নায়েব চরিত্রে সত্যজিৎ দত্ত চৌধুরী গৌতম স্বকীয় মেধায় চরিত্রটিকে আলোকিত করেছেন।

হাছন রাজার ‘মতি’ ফেরাতে হুরমত জাহান বিবি নায়েবের সহায়তায় বাঈজীর সজ্জা নিয়েছিলেন, কাহিনীতে এমনটিই দেখানো হয়েছে। এ দৃশ্যপট নিয়ে মতান্তর রয়েছে। এ বিষয়ে হাছন রাজার পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়ান সামেরিন রাজা চৌধুরী বেশ আগেই আপত্তি জানিয়ে তিনি আইনের দ্বারস্থ হতে চেয়েছিলেন। হুরমত জাহান বিবি জমিদারী পরিচালনায় অত্যন্ত দক্ষ, পর্দানসীন এবং বিদূষী ছিলেন। তাঁর মতো বিদূষী মহিলার পক্ষে কোন কারনে কখনোই বাঈজির সাজ নিয়ে পুত্রের সামনে আসা সম্ভব নয়, এমন মানষিকতার মহিলাও তিনি ছিলেন না। তাছাড়া হাছন রাজার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী যখন হুরমত জাহান বিবিকে বিয়ে করেন তখন তিনি ছিলেন প্রায় চল্লিশের কোঠায় পা দেয়া একজন নি:সন্তান বিধবা। হাছন রাজার পরিণত বয়সে তার মা হুরমত জাহান বিবির বয়স কতো হতে পারে তা প্রশ্নের দাবি রাখে বৈকি। ‘হাছন’র সুমতি বা বৈরাগ্যের পেছনে রয়েছে ভিন্ন কারন। ছোটখাঠো ত্রুটি এড়িয়ে গলে হাছন রাজার মায়ের চরিত্রে শর্মিলা দেব সফল হয়েছেন, নন্দিত হয়েছেন।

চন্দ্রা; দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী যাকে সর্বাত্মকরণে ভালোবেসেছিলেন। সেই চন্দ্রার চরিত্রে অদিতি দাস যথেষ্ঠ মানানসই ছিলেন। নিজ প্রতিভা আর মেধায় দর্শক নন্দিত এই মঞ্চাভিনেত্রী চন্দ্রা চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারণ সাফল্যে।

হাছন রাজার স্ত্রী আজিজাবানুর চরিত্রে অসাধারণ সাফল্যগাঁথা তুলে এনেছেন পরাগরেনু দেব তমা। শুধু আজিজা বানু নয়, অনন্য সাধারণ কণ্ঠ আর সপ্রতিভ মেধায় পুরো মঞ্চ আলোকিত করে রেখেছিলেন তিনি।

সিলেটের থিয়েটার আন্দোলনের কথা বলতে গেলে যার নামটি সশ্রদ্ধায় উঠে আসে তিনি আমাদের চম্পক’দা; চম্পক সরকার। হাছন রাজার আলোক প্রক্ষেপনে স্বতন্ত্র মুন্সিয়ানা দেখে ‘রোজকার’ দর্শক সহজেই বুঝে নিতে পারেন এই আলোর পেছনে যার হাত তিনি আরেকজন আলোকিত মানুষ চম্পক সরকার।

প্রায় দেড়শ’ বছরেরও আগের কাহিনী স্মৃতি এবং শ্রুতি থেকে এ পর্যন্ত গড়িয়েছে। ফলে কাহিনীতে কিছুটা তারতম্য থাকা অস্বাভাবিক নয়। নাট্যকার ‘হাছন রাজা’কে মঞ্চে এনে একটি অসামন্য গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। তার হাত থেকেই হাছন রাজার মতো আরো কোন জীবনের পটভূমি থেকে দর্শক নন্দিত আরো কোন নতুন নাটক উঠে আসবে, এ প্রত্যাশা দর্শকদের।

লেখক: সিলেট ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন