আজ শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪ ইং
সজল ঘোষ :: দেশের সাংবাদিকরা কয়েকদিন পরপর ভয়াবহ নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হন। প্রতিনিয়তই পেশাগত কাজ করতে গিয়ে হয়রানীর শিকার হন। বিষাদ ভারাক্রান্ত হয়ে বলতে হয় সাংবাদিকদের কোথাও আজ নিরাপত্তা নেই।
বলা যায়, সকল সময় দেশের সাংবাদিকরা নিরাপত্তাহীন থাকেন। মাতৃভুমিকে ভালোবেসে দেশের ছোট-বড় দুর্ধর্ষ অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করতে গিয়ে সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। আর এই কাজ করতে গিয়েই অপরাধীদের বিষাক্ত ছোবলে প্রাণও দিতে হয় সাংবাদিকদের। দেশের সাংবাদিকরা দেশপ্রেমে মত্ত হয়ে এ পেশায় শতকষ্ঠেও দিন-রাত কাজ করেন। অথচ সাংবাদিকরা বিনিময়ে কিছুই পান না। শুধু পান অনাদর-অবহেলা, হুমকি-ধামকি এবং চরম নির্যাতন। গত ১৭ মে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। সেখানে ৫ ঘণ্টার বেশি সময় তাকে আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাত ৯টার দিকে তাকে সচিবালয় থেকে শাহবাগ থানায় আনা হয়।
সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন।
একদিকে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও নানারকম ভয়ভীতি-হুমকির কারণে সাংবাদিকতার পরিসর সংকুচিত হয়ে উঠছে; আরেক দিকে, শারীরিকভাবে হামলা ও হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। এসব হামলা-নির্যাতন সাংবাদিকতা পেশাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে এবং তথ্যপ্রকাশে বাধা দেওয়ার মধ্য দিয়ে তা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকেও খর্ব করছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সাংবাদিক নেতারা অভিযোগ করে আসছেন, সাংবাদিক নির্যাতন ও সাংবাদিক হত্যার যথাযথ বিচার না হওয়া স্পষ্টতই অপরাধীদের দায়মুক্তি দিচ্ছে। কিন্তু গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধে সদিচ্ছার প্রমাণ রাখতে হবে সরকারকে।
সচিবালয়ে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে তার ওপর চালানো নিপীড়ন, পরে মামলা দিয়ে থানায় পাঠানো ও আটকের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে দেশবাসী। সকলে এক বাক্যে এ ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। সাধারণের এই সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া অভূতপূর্ব হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। কেননা অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ক্রমেই বিপদসংকুল হয়ে উঠেছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকরা প্রায়ই প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম এর সবশেষ উদাহরণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাকে আটকে রেখে হেনস্তা করেই ক্ষান্ত হননি। তার বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় এবং অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। অথচ ১৯২৩ সালের এই আইন তামাদি, অপ্রাসঙ্গিক ও তথ্যঅধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে সমাজে জোরালো মত রয়েছে। যে আইন বাতিল করা সরকারের দায়িত্ব সে আইনে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার ঘটনা বিস্ময় জন্ম দিয়েছে। এই মামলায় মঙ্গলবার তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
সাংবাদিকরা তথ্য পাওয়ার জন্য নানা পদ্ধতি ও কৌশল বেছে নিয়ে থাকেন। বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেন। এ পদ্ধতি সারাবিশ্বেই বহুলভাবে স্বীকৃত। তথ্য সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য সহকারে তা প্রকাশ করা সাংবাদিকের কাজ। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের জন্য এসব পদ্ধতি ও কৌশলের কোনো বিকল্প নেই। অথচ পেশাগত কাজ করতে গিয়েই রোজিনাকে নির্যাতন ও মামলার শিকার হতে হলো। যেভাবে তাকে আটকে রাখা হয়েছে তা সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা হিসেবেই বিবেচিত হবে। স্বাধীন সংবাদচর্চা ও মতপ্রকাশের জন্য এ ধরনের ঘটনা নেতিবাচক ফল বয়ে আনে। অথচ হতাশাজনকভাবে, দেশে একের পর এক সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সম্পাদক, প্রকাশক ও সাংবাদিকরা গ্রেফতারও হয়েছেন।
দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক ভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয় সকল সময়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হলো অনিয়ম দুর্নীতির সেরা জায়গা। সাহসী সাংবাদিক রোজিনা সাম্প্রতিক সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ কিছু আলোচিত প্রতিবেদন করেছেন। নিয়োগ দুর্নীতি নিয়েও প্রতিবেদন করেছেন।
ধারণা করা হচ্ছে, এসব প্রতিবেদনের কারণে রোজিনা ইসলাম আক্রোশের শিকার হয়েছেন। প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে কেউ বিক্ষুব্ধ হলে তিনি আদালতের দারস্থ হতে পারেন, প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে এর প্রতিবিধান চাইতে পারেন, প্রতিবাদলিপি সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু এসব কোনো পথে না গিয়ে সাংবাদিককে আটকে রেখে নির্যাতন ও মামলা দেওয়ার ঘটনা কোনোভাবে সমর্থন করা যায় না। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাংবাদিকরা। দেশের বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মীসহ সচেতন সকল মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠন নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের তরফে সক্রিয় হয়ে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে নির্যাতনের যে ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে তা দেখে স্পষ্টতই বোঝা যায়, তার ওপর আক্রমণকারীরা কতটা নির্দয় ও ভয়ানক। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দফতরে কর্মরতদের এমন শারীরিক ভঙ্গি খুবই আশঙ্কার। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে যে নথি চুরির অভিযোগ তোলা হয়েছে, এমনকি সেটি সত্য হলেও তাকে আটকে রেখে শারীরিকভাবে হেনস্তার অধিকার আইন কাউকে দেয়নি। কোনোরকমের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই সচিবালয়ে একজন নারী সাংবাদিককে আটকে রেখে শারীরিকভাবে হেনস্তা করা কর্মকর্তাদের আচরণবিধির পরিপন্থী। এটি ফৌজদারি অপরাধের শামিল। এর প্রতিকার হিসেবে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
দেশের সাধারণ নাগরিকরা মনে করেন, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের উদ্দেশ্যেই সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। তার ওপর নির্যাতন চালানো কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবিও উঠছে। আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মুক্ত গণমাধ্যম রক্ষার স্বার্থে সরকারের দ্রুত এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া দরকার। একই সঙ্গে আগামীতে যাতে সাংবাদিকরা নির্বিঘ্নে ও নির্ভয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে সরকারসহ সকল মহলকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দরকার। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ব গণমাধ্যমকে পাশ কাটিয়ে চলাচল করা হবে দেশেকে অন্ধকারে ফেলা। সুতরাং গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বাঁচাতে এক যোগে কাজ করে যেতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও গীতিকার।