আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

৭ই মার্চের ভাষণ আছে বলেই বাংলাদেশ পাকিস্তান হয়ে যায়নি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৩-১০ ০০:৪৮:৫৩

সুজাত মনসুর :: ৭ই মার্চের ভাষণ আছে বলেই বাংলাদেশ পাকিস্তান হয়ে যায়নিকথা হচ্ছিল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি নির্মলেন্দু গুণের সাথে দুরালাপনিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা তাঁর বিভিন্ন কবিতা নিয়ে। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম কবি যিনি পঁচাত্তরের পনেরোই আগষ্ট, বাঙালি জাতি ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী , সাম্রাজ্যবাদী আর মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুদের পোষ্য, পেশাধার খুনিদের হাতে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে হত হবার পর ছন্দে ছন্দে তার প্রতিবাদ করেছিলেন। জাগিয়ে রেখেছিলেন আমাদের আশার আলো।

কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ, যা একমাত্র কালোত্তীর্ণ ভাষণ হিসেবে পৃথিবীতে ঠিকে আছে এবং থাকবে কালের পর কাল। তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, অনেকেই সাতই মার্চের ভাষণকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল কিংবা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ এ্যাড্রেসের সাথে তুলনা করে পুলকিত হন। কিংবা তাদের ভাষণের পাশাপাশি ক্রমিক সংখ্যানুসারে অনেক পেছনে পুস্তক বন্দি হয়ে প্রকাশিত হওয়ায় আনন্দিত। বিশ্বের বরেণ্য নেতাদের ভাষণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি স্থান পাওয়ায় আমরা পুলকিত কিংবা আনন্দিত হবো সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। সাতই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও আবেদন বিবেচনায় আর কোন ভাষণের সাথেই তুলনা হতে পারে না। অন্য কোন ভাষণই কালোত্তীর্ণ, এমনকি যুগোত্তীর্ণও নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার সাথে সাথে চার্চিলের ভাষণের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে কিংবা আমেরিকার সেই বিখ্যাত গৃহ-বিবাদের পর লিংকনের ভাষণেরও আবেদন ফুরিয়ে গেছে। যদিও অনেকে এখনো সেই ভাষনের তিনটি লাইন মৃতপ্রায় বর্জোয়া গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হিসেবে আওড়াতে পছন্দ করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আবেদন এবং প্রয়োজনীয়তা এখনো শেষ হয়ে যায়নি, বরং আরো প্রকটভাবে অনুভুত হচ্ছে দিনকে দিন। এবং এর আবেদন কিংবা উপযোগিতা তখনই হয়তো ফুরিয়ে যেতে পারে যেদিন প্রকৃত অর্থেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা শতভাগ পুর্ণতা লাভ করবে। অর্থাৎ যেদিন আমাদের মাতৃভুমিকে সত্যিকার অর্থেই একটি মানবিক বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো। তাঁর সাথে আলাপ করে আরো একটি বিষয় যেটি আমাকে বেশি নাড়া দিয়েছে, তাহলো সাতই মার্চের ভাষণ ছিলো বলেই পঁচাত্তরের পনেরোই আগষ্টের পর, বাংলাদেশ পাকিস্তানে পরিণত হয়নি। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক পরে হলেও আবারো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরে এসেছে এবং আবারো স্বপ্ন দেখছি একটি পরিপূর্ণ মানবিক ও উন্নত বাংলাদেশের।

প্রিয় কবির সাথে আলাপরত অবস্থায়্ই ফিরে গিয়েছিলাম শৈশব-কৈশোর-যৌবনে। বর্তমানতো আছেই। একাত্তুরের সাতই মার্চ বয়সইবা কত ছিল, বারো-তের? তবে রাজনৈতিক জ্ঞান কিছুটা হলেও অর্জন করতে পেরেছি আব্দুস সামাদ আজাদের সান্নিধ্যে এসে এবং মুজিবাদর্শের একজন ক্ষুদে কর্মী হিসেবে। ইতোমধ্যে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুকে চাক্ষুষ দেখার এবং মাথায় আশীর্বার্দে পরশ বুলানোর সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সারাদেশের মতো আমাদের এলাকায়ও(সুনামগঞ্জের দিরাই থানা) চরম উত্তেজনা-কানাঘুষা। কি হতে যাচ্ছে দেশের পরিস্থতি, বঙ্গবন্ধু কি তাঁর ভাষণের স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন? যদি দেন তাহলে কি হবে? বড়রা আলোচনা করেন আর আমরা শুনি, নিজেদের মধ্যে একটা উত্তেজনা অনুভব করি। শোনা গেল রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।

আব্বা-আম্মা-বড়বোন-বড়ভাই’র সাথে গোল হয়ে বসলাম রেডিওর সামনে ভাষণ শোনার জন্যে। কিন্তু হতাশ হতে হলো। রেডিওত ভাষণটি সরাসরি প্রচার করা হলো না। সামরিক শাসকরা নাকি তা প্রচার করতে দেয়নি। প্রতিবাদে বেতারকর্মীরা হুমকি দিলেন যদি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করতে না দেয়া তাহলে তারা আর কাজ করবেন না। রেডিও সম্প্রচার বন্ধ করে দেবেন। বন্ধও হয়ে গেলো।প্রমাদ গুনলো সামরিক শাসক অথবা হয়তো কৌশলগত কারনেই পরদিন সকালে, সম্ভবতঃ সাড়ে আটটায় প্রচার করতে দিল। পরিবারের সবার সাথে আমিও শুনলাম। অনুভুতি কি হয়েছিল তা আর বর্ণনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কতিপয় কুলাঙ্গার আর জারজ ছাড়া সমগ্র বাঙালি জাতির যে অনুভুতি হয়েছিল আমার কিংবা আমাদের সবার অনুভুতি তা থেকে ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। তারপর তো পুরো মুক্তিযুদ্ধ জড়েই সে ভাষণটি শোনার জন্যে প্রতিনিয়ত অপেক্ষমান থাকতাম। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রতিদিনই কয়েকবার ভাষণটি প্রচার করা হতো। দেশের ভিতরে বাঙালি জাতিকে যেমন ভাষণটি একটি নতুন দেশ-জাতির উন্মেষের প্রত্যাশায় প্রেরণা যোগাতো, রণাঙ্গেেন মুক্তিযোদ্ধাকে সাহস যোগাতো এবং শরনার্ণী শিবিরের লাখো লাখো শরনার্থীকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগাতো।

দেশ স্বাধীন হয়েছে। রক্তস্নাত আর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসেছেন বিজয়ীর বেশে-মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে। হয়েছেন রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী আবার রাষ্ট্রপতি। সরকার প্রধান হিসেবে নীতি-নির্ধারণী অনেক বক্তৃতা করেছেন, আহবান জানিয়েছেন দেশ গড়ার কাজে নিঃস্বার্থভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্যে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শতভাগ সম্মাান রেখেই বলতে চাই, সেই আবেদন-নিবেদন-হুমকি-ধামকি অনেক সময়ই অরণ্যেরোদনে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রী-এমপি-দলীয় নেতাকর্মীরা পর্যন্ত আমলে নেয়নি। অথচ এরাই কিন্তু সাতই মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবনবাজি রেখে মরণপণ যুদ্ধ করেছে। দেশ স্বাধীন করেছে নেতার অবর্তমানে। আমলাসহ অন্যান্য শ্রেনীর মানুষের কথা নাই বললাম। বঙ্গবন্ধু নিজেই আক্ষেপ করে বলতেন, ‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী।’ ‘লালঘোড়া দাবড়িয়ে দেবো।’ যখনই সত্যিকার অর্থেই লালঘোড়া দাবড়াতে গেলেন তখনই তাকে নিহত হতে হলো। সে অন্য প্রসঙ্গ।

ফিরে দেখি যৌবনকে। স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর যারা ক্ষমতায় এলো, তারা পুরোপুরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তি। শুরুতে তারা মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বণি ‘জয় বাংলা’ জলাঞ্জলি দিয়ে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ নিলে এলো। বাংলাদেশ বেতার হয়ে গেল রেডিও বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন বর্জিত হলো। দেশের যাত্রা শুরু হলো মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরের দিকে। আমরা যারা মুজিবাদর্শ আর মুক্তিযুদ্ধকে শতভাগ অন্তুরে লালন করি তারা হলাম দিশেহারা। দিকনির্দেশনাহীন-নেতৃত্বহীন। যার বলে রুখে দিতে পারি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র। কিন্তু না, দিশেহারা আমরা-নেতৃত্বহীন আমরা আবারো দিশা পেলাম, নেতৃত্ব পেলাম, নতুন করে বাঁচার আশা পেলাম মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে। মন্ত্র একটাই সাতই মার্চের ভাষণের সেই অমোঘ বাণী। ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা প্রস্তুত থেকো। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলো।’ ‘মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ্’। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

আজকের যে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনাার বাংলার অভিলাষী বাংলাদেশ, মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অভিযাত্রী, একদিনে হয়ে ওঠেনি। প্রায় তিনটি দশক আমাদের লড়াই করতে হয়েছে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে। আমার মতো হাজারো তরুণের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবন চলে গিয়েছে রাস্তায়-পথে-প্রান্তরে দানবের সাথে যুদ্ধে। অনেকেই জীবন দিয়েছে, কারাভোগ করেছে, পঙ্গু হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। কিন্তু আপোষ করেনি, মাথানত করেনি। প্রেরণা কিন্তু একটাই বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ আর জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বণি। নেতা আমাদের শেখ হাসিনা যার ধমনীতে শেখ মুজির আর বেগম ফজিলাতুন্নেসার রক্ত। পিতার মতোই যার বাংলা আর বাঙালির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। পণ একটাই বাঙালির সার্বিক মুক্তি-মানবিক বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।

লড়াই কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। দানবেরা আজো চুড়ান্ত আঘাত হানার চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনার জীবন সংশয় হয়েছে একুশবার। চলছে বাংলাদেশকে অকার্যকর আর জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র। মদদদাতা কিংবা ষড়যন্ত্রকারী কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী দেশি-বিদেশি শক্তি। সাথে আছে বরাবরের মতোই কিছু অতি-বাম রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি। কিন্তু তারা পরাজিত হতে বাধ্য। ওরা অন্ধকারের জীব-দানবিক শক্তি, ওরা বিভ্রান্ত। অন্যদিকে আমাদের আছে কালোত্তীর্ণ অমোঘ মন্ত্র, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ। আছে নির্দেশনা কখন কি করতে হবে। কখন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। আছে মুক্তির সংগ্রামের আহŸান। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পুজারী-আলোর পথের যাত্রী। প্রদীপ হাতে আমাদের পথ-প্রদর্শক শেখ হাসিনা। মন্ত্র আর পথ নির্দেশনা একটাই সাতই মার্চের ভাষণ। সুতরাং যতদিন সাতই মার্চের ভাষণ আমাদেরকে পথ-নির্দেশনা দেবে, যতদিন শেখ হাসিনা বেঁচে থাকবেন ততদিন আমরা পথ হারাবো না। আমরা পরাজিত হবো না। আমরা একটি পরিপূর্ণ মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলবোই। জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু-জয়তু শেখ হাসিনা।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
suzatmansur@yahoo.com

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন