আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

আসুন ইতিহাসের অংশ হই

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৪-০৫ ১৫:০৬:২৯

সুজাত মনসুর :: ১৯৪৩ সালে প্রখ্যাত মনীষী এস. ওয়াজেদ আলী তাঁর ‘বাঙালি মুসলমান’ অভিভাষণে বলেছিলেন, “বাঙালি তা হিন্দুই হউক আর আর মুসলমানই হউক, ভবিষ্যত আশার কেন্দ্র হচ্ছে পুর্ববঙ্গ।” অন্যদিকে, ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত এস. ওয়াজেদ আলীর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ভবিষ্যতের বাঙালি’-তে তিনি লিখেছেন, “প্রাকৃতিক কারনে ভারতবর্ষ যে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট খন্ডে বিভক্ত হয়ে গেছে, তার মধ্যে আমাদের বাংলাদেশ অন্যতম।----

আমার মনে হয়, প্রকৃতি দেবী, ভারতের এই পুর্ব এ ভুখন্ডে নুতন এক জাতির, নুতন এক সভ্যতার, নুতন এক জীবনধারার, নুতন এক কৃষ্টির, নুতন এক আদর্শের সৃষ্টি প্রয়াসে নীরত আছেন।

-----সেই শুভ দিন আসবে, তখন বাঙালি কেবল ভারতবর্ষের নয়, কেবল প্রাচ্য ভুখন্ডের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হবে-সত্য, সুন্দর শুভ জীবনপথের। বাঙালি এখন সেই মহামানবের প্রতীক্ষায় আছে, যিনি তাকে এই গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেবেন-ভাগীরথের মতো এই বাংলা ভাবগঙ্গার সঙ্গম সুষ্পষ্ট করে তুলবেন।”

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশার বাণী শুনিয়ে বলেছিলেন যে, “এই দারিদ্র-লাঞ্ছিত দেশে এক পরিত্রাণকর্তার দেখা পাবেন, যিনি মানুষকে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা শোনাবেন।” কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, তাঁর ‘স্বাধীনতার স্বপ্নের প্রতীক’ প্রবন্ধে মনীষী এস. ওয়াজেদ আলী এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্ধৃতির উল্লেখ করে বলেছেন, তাঁর মতে “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন সেই কাংখিত মানুষ।” যিনি বাঙালিকে মুক্তির গান শুনিয়ে একটা স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।-(সুজাত মনসুর সম্পাদিত মুজিব মানেই মুক্তি, পৃষ্ঠা-৬৪ ও ৬৫)

মনীষী এস. ওয়াজেদ আলী ও কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কাঙ্ক্ষিত বাংলা ও বাঙালির মুক্তির দূত, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী আগামী বছরের সতেরোই মার্চ। ১৯২০ সালের এইদিনেই ভাটির জনপদ, মধুমতি বিধৌত টুঙ্গিপাড়ার ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন ক্ষণজন্মা এই মহামানব। আমরা জানি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীকে ইতিহাসে অমর করে রাখার জন্য ২০২০ সালকে 'মুজিব বর্ষ' ঘোষণা করেছে। সারাবছরই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন, জীবনাদর্শ, ত্যাগ-তিতিক্ষা, বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তুলে ধরা হবে দেশ ও প্রবাসের-বাঙালিদের মধ্যে। তবে অবশ্যই মূল টার্গেট গ্রুপ হবে বা হওয়া দরকার আমাদের নতুন প্রজন্ম।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মহেন্দ্রক্ষণ আগামী বছরের সতেরোই মার্চ ও মুজিব বর্ষ আগামী বছর হলেও এখন থেকেই দেশে ও বিদেশে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। দেশে সরকারিভাবে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্যসচিব কামাল আব্দুল নাসেরকে প্রধান সমন্বয়ক করে ৬১ সদস্য বিশিষ্ট একটা বাস্তবায়ন কমিটি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সভাপতি করে ১০২ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ রেহানাসহ নাগরিক সমাজের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক কমিটির একটা প্রস্তুতি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ সেই সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিব বর্ষকে বিশাল ও বর্ণাঢ্য করার জন্য এখন থেকেই তৃণমূল পর্যায়ে প্রস্ততি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। ভারতের আগরতলাতেও গত সতেরোই মার্চ বঙ্গবন্ধুর নিরানব্বইতম জন্মবার্ষিকী পালনের মধ্যদিয়ে জন্মশতবার্ষিকী পালনের সূচনা করা হয়েছে। জাতীয় কমিটি ছাড়াও আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানও বিভিন্ন বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে বছরব্যাপি সেটাই প্রত্যাশা।

বিলেতেও আমরা জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী পালনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছি এবং ৯ই এপ্রিল বিলেতে জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা নব প্রজন্মের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হবে আমাদের বছরব্যাপি অনুষ্ঠানমালার দ্বিতীয়পর্ব। প্রথমপর্ব ছিলো ২৯শে জানুয়ারী বিলেতে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য নাগরিক কমিটি গঠনের লক্ষ্যে প্রস্ততিসভা। এরপর আমাদের আরো যেসব অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে তাহলো, ৭ই জুন হাউস অব কমন্সে 'ছয়দফা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ' শীর্ষক সেমিনার, সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে 'গীতি-কবিতায় বঙ্গবন্ধু', জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও দর্শন নিয়ে একটা উন্নতমানের প্রকাশনা, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ইংরেজি ভার্সন থেকে বাছাইকৃত অংশ নিয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য প্রকাশনা ও সতেরোই মার্চ ২০২০ সালে পুর্ব লন্ডনে বর্ণাঢ্য র‌্যালি, শিশু-কিশোর সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী আরো অনেক আয়োজন। আমার জানামতে বিলেতে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনে আমাদের নাগরিক উদ্যোগই হচ্ছে সর্বপ্রথম উদ্যোগ। সুতরাং প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে ইতিহাসের অংশ হওয়াতে আমরা বিলেত প্রবাসী বাঙালিরা গৌরব করার অধিকার রাখি বৈকি! কেবল সম্মিলিত নাগরিক কমিটিই নয়, ইতোমধ্যেই লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগও ইতোমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীকে অমর করে রাখার জন্য।

বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা। তিনি সমগ্র বাঙালি জাতির। সুতরাং বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তরে লালনকারী প্রতিটি বাঙালির স্বাধীনতার মহানায়কের জন্মশতবার্ষিকী পালনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাধ্যমত ভূমিকা রাখা বাঞ্ছনীয়। আবার সমগ্র বাঙালি জাতি যাতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনকের জন্মশতবার্ষিকী পালনে ভূমিকা রাখতে পারে সে সুযোগ সুবিধা করে দেওয়াও কারো না কারো দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সেই দায়িত্ববোধের উপলব্ধি থেকেই আমরা বঙ্গবন্ধু লেখক-সাংবাদিক ফোরাম, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক ফোরাম, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, অল ইউরোপীয়ান আওয়ামী সোসাইটি এবং কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংস্কৃতিক ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব উদ্যোগি হয়েছি সকলের অংশগ্রহণে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির প্রতি যথাযথ সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শনের। বিলেতের এই নাগরিক উদ্যোগ বেশ সাড়া জাগিয়েছে ও অনেকেই স্বপ্রনোদিত হয়ে আমাদের উদ্যোগের সাথে যুক্ত হয়েছেন বা ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে কেউ কেউ আছেন, যারা বঙ্গবন্ধু যে সার্বজনীন বিষযটি মানতে চান না। একটা নিজস্ব গন্ডীর মধ্যে আটকে রাখতে চায়। দলীয়করণ করতে চায়। তা কি করে সম্ভব? বঙ্গবন্ধু তাঁর কর্ম আর কৃতিত্বে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বমানবের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন ১৯৭১ সালে একটি দেশ ও জাতির উত্থানের মধ্যদিয়ে। তাই তিনি বিশ্বমানবের নেতা। বিশ্বের নিপীড়িত-বঞ্চিত-শোষিত মানুষের মুক্তির দিশারী, বাতিঘর।

বিশ্বমানবের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজে যতটা না মহিমান্বিত হয়েছেন, তারচেয়ে বেশি মহিমান্বিত হয়েছি বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা। আমাদের ভাষা বাংলা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা। জাতিসংঘে যে ৮টি ভাষায় বক্তৃতা করা হয় তারমধ্যে বাংলা হলো অন্যতম। তাও সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কারনে। তিনি যদি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে এবং অন্যান্য দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের মতো ইংরেজিতে বক্তৃতা করতেন, তাহলে বাংলা আর কখনোই জাতিসংঘের ভাষা হতো না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা করেননি। তিনি প্রথম সুযোগেই রক্তে কেনা বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম ভাষা করে নিলেন। তিনি বললেন, ইংরেজিতে নয়, বাংলায় বক্তব্য রাখবেন। অন্যান্য দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা একবাক্যে তা মেনে নিলেন। এটা ছিলো বাংলা, বাঙালি আর বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বনেতাদের বিরল সম্মান। শুধু তাই নয়, আজ যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভূতপুর্ব উন্নয়ন, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া, উন্নয়নের মডেল রূপে বিশ্বে চিহ্নিত হওয়া, সবই বঙ্গবন্ধুর কারনে। তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছরে একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে যে শক্ত ভিতের দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন, তাই হলো বাঙালি জাতির অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলার মূল ভিত্তি। আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল করা ও খাদ্য ভর্তি জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে ১৯৭৪ সালে যে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিলো আমেরিকা ও তাঁর অন্যান্য মিত্ররা মিলে, তাকে বঙ্গবন্ধু চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ১৯৭৫ সালের প্রথমদিকে দেশে ধানের যে বাম্পার ফসল ঘটিয়েছিলেন, তাতেই তিনি প্রমাণ করেছিলেন বাংলা ও বাঙালি চাইলেই অসাধ্য সাধন করতে পারে। পরবর্তীতে জিয়া ক্ষমতায় এসে সেই বাম্পার ফসল ফলানোর সুফল ভোগ করেছিলো। আজ বঙ্গবন্ধু কন্যাই পিতার গড়ে যাওয়া ভিত ও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বাংলাদেশকে একটা সুখি-সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করার পথে এগিয়ে চলেছেন।

আজ সময় এসেছে বিশ্বমানবের নেতা, আমাদের জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালনের মাধ্যমে মহামানবের প্রতি সম্মান প্রদর্শণের। আমরা যেমন বিশ্ব ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে অতীতে অনেক কালজয়ী পদক্ষেপ রাখতে সক্ষম হয়েছি, তেমনি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিব বর্ষকেও আরেকটি কালজয়ী অধ্যায় হিসেবে বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রাখতে চাই। বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখুক বাঙালি জাতি তার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়েছে। আরেকটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আর সেই ইতিহাসের অংশ হতে আসুন আমরাও ব্রতী হই। যুক্ত করি আমাদের নতুন প্রজন্মের গর্বিত সন্তানদের।

লেখকঃ যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন