আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

২১ আগস্ট: একজন পথচারীর চোখে সেদিনের সেই নারকীয় বিকেল

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৮-২০ ২০:৩১:৩১

একুশে আগস্ট, ২০০৪। খিলগাঁওয়ের বাস ধরার জন্য গোলাপ শাহ মাজারের পাশে অপেক্ষমান আমি। বিকেল অনুমান ছয়টা। লোকে লোকারণ্য পুরো এলাকা। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নাকি দলীয় সভা চলছে। হঠাৎ কান ফাটানো শব্দ। ভূমিকম্পের মত কেঁপে উঠলো মাটি। একের পর এক আওয়াজ এসে ত্রস্ত-বিস্রস্ত করে দিলো জনতার ভীড়। গুচ্ছ গুচ্ছ পুলিশের ত্বরিত ঢাল-অস্ত্র গুছানো দেখে আতংক গ্রাস করছে জনতাকে। সারা দেশে তখন বোমা আতংকের যুগ চলছে। আজ এখানে তো কাল ওখানে, বোমা ফাটছে যখন-তখন। সাইকেলের টায়ার ফাটলেও মানুষ বোমার শব্দ মনে করে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। আর এ যে মাটি কাঁপানো শব্দ। কি জানি কি হচ্ছে, পিঁপড়ার মত ঠাসা এই শহুরে মানুষগুলোকে হয়তো বড় বড় বোমা ছুড়ে হাজারে হাজারে মেরে ফেলার নগ্ন উল্লাসে মেতে উঠেছে কেউ। তেমনটা হলে এ যাত্রায় বেঁচে যাবার সম্ভাবনা খুব অল্প। হাতে তোষকের ভার। ছুড়ে ফেলেও দিতে পারছি না। ছাত্র জীবনের অভাব লেগে থাকা সময়গুলো কাঙালপনার একশেষ ছিলো। সামান্য তোষকের মায়া কাটানোও অসম্ভব।

নিশ্চিত মূত্যু ধেয়ে আসছে জেনেও হাতে শক্ত করে ধরে থাকা তোষক নিয়ে এলোপাতাড়ি ছুটোছুটি। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে ছুটন্ত মানুষের স্রোত ঝড়ের মত সব ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে আমাকেও। কি হচ্ছে, কিছু কি বুঝা গেলো? না, এখনো পরিস্কার নয়। নিজের মাথায় বোমা এসে পড়ার আগে বুঝি সেটি আর বোঝারও উপায় নেই। ভ্যান-রিক্সা, গাড়িগুলো যেদিকে ফাঁকা দেখছে অন্ধের মত ছুটছে। যাত্রী নিয়ে অথবা যাত্রী ফেলে। ড্রাইভারেরও জীবন আছে, আছে মৃত্যুর ভয়। জীবন আছে পুলিশেরও। হাতে থাকা অস্ত্র গুছিয়ে জনতার নিরাপত্তা নয়, বরং নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। পরে বুঝেছি, অত বড় একটি পরিকল্পনার কথা সামান্য কনস্টেবলের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। জনগণের চাকরি করছে ভেবে জনগণের টাকায় কেনা অস্ত্রটি গুছিয়ে নিচ্ছে। জনগণের নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব না হলেও অন্তত নিজের নিরাপত্তার শেষ চেষ্টা তো করা যায়। গুচ্ছ গুচ্ছ পুলিশ সেটাই করছিলো আর কি।

হকার, চটপটির দোকানদার, ঝালমুড়িওয়ালা, ফুটপাতের দোকানদার সবাই প্রাণ হাতে নিয়ে এলাকা ফাঁকা করে ছুটে যাচ্ছে। কেনাকাটা করতে আসা মানুষগুলো রাস্তায় নেমে প্রাণ হাতে করে ছুটছে। সদরঘাট অভিমুখী ঘোড়ার গাড়িগুলো প্রাণপণ দৌড়ে দক্ষিণ দিকে চলে যাচ্ছে। ঘোড়াগুলোরও আছে প্রাণ হারানোর ভয়। ওসমানী উদ্যানের ফাঁকা জঙ্গলে ভাসমান মানুষের দল আবাস ছেড়ে ছুটে পালাচ্ছে। পূর্ব ও দক্ষিণের খোলা সীমানা পার হয়ে দিক-বিদিক পালাচ্ছে মানুষ। লক্ষ লক্ষ মানুষের এমন থরহরি দশা এই বাংলায় একাত্তর ছাড়া আসে নি আর। চতুর্দিকে মৃত্যুর ছায়া। মরে যেতে পারে যে কেউ। বিনা কারনে বেঘোরে প্রাণ খুয়ানোর আতংকে জীয়ন্তে মরা মানুষগুলো যেন লাশের শরীর নিয়ে ছুটছে। ওসমানী উদ্যানের ফাঁকা পথ দিয়ে প্রথম যে আহত মানুষটি দৌড়ে পালালো, তার কাছ থেকে জানা গেলো বৃত্তান্ত। জনসভায় সভানেত্রীর বক্তব্য দেয়ার সময় গ্রেনেড হামলা হয়েছে। শত শত আহত মানুষের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে গেছে বাতাস। রক্তের স্রোতে লাল হয়ে গেছে পিচঢালা জমিন। শেখ হাসিনাকে বহন করা গাড়ি হাসপাতালের দিকে ছুটে গেলো। নির্মমভাবে আহত আইভি রহমানকে হাসপাতালে নেয়ার তোড়জোড় চলছে। সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে রাখা মানববর্ম রচনাকারী নেতাদেরও হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। নেত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে গুলি হজম করা দেহরক্ষীর গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে। ছুটন্ত মানুষের পরিত্যক্ত জুতা-সেন্ডেলে সয়লাব হয়ে আছে পুরো এলাকা।

ওসমানী উদ্যানের পশ্চিম পাশ থেকে গাড়িতে উঠে খিলগাঁওয়ের দিকে যেতে যেতে শুনলাম এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান। জনসভার অদূরে দাড়িয়ে গ্রেনেড ছোঁড়ার ভঙ্গি সে দেখেছে। ছুড়তে দেখার সময় তার মনেই হয় নি, ওগুলো গ্রেনেড হতে পারে। কোনো সুস্থ মানুষ ওভাবে নিরীহ মানুষের ভীড় লক্ষ্য বোমা ছুড়তে পারে, এটি কোনো মানুষেরই মাথায় আসার কথা নয়। একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রীকে মারতে এত মানুষের ভীড়ে গ্রেনেড ছুড়ে মারার নির্মমতা বাংলায় কখনো দেখা যায় নি। যুদ্ধের সময় আকাশ থেকে বোমা ফেলার নজির আছে পৃথিবীতে। পঁচাত্তরের পনের আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চালানো ব্রাশ ফায়ারে রক্তাক্ত হয়েছে বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডি। ধরে ধরে বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজনকে হত্যা করা হয়েছে। আর আজ, তারই কন্যাকে হত্যা করতে প্রকাশ্যে অজস্র মানুষের ভীড় লক্ষ্য করে ছোড়া হচ্ছে গ্রেনেড!

গুলিস্তানের রক্তে ভেজা রাজপথ, পিচের পথ অসংখ্য নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরার সাক্ষী। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের এ ঘৃণ্য প্রকাশ মানুষের বিবেককে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায়। হত্যার এ রাজনীতি কতটা জঘণ্য, তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী সেদিনের গুলিস্তানে উপস্থিত থাকা প্রতিটি মানুষ। সাক্ষী ছিলাম আমি, আমার হাতের তোষক। হাতের মধ্যে কেঁপে ওঠা তোষকও প্রাণভয়ে শঙ্কিত হয়েছিলো। সেদিনের গুলিস্তানের মাটি ভয় পেয়েছিলো, ওসমানী উদ্যানের প্রতিটি বৃক্ষ, লতা ও পাতা প্রাণভয়ে মুষড়ে উঠেছিলো। লোহার গ্রিল আর ইটের দালান নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞে ভীত হয়ে পড়েছিলো। বাতাসে ভেসে এসেছিলো হাজার বছরের বেদনার্ত কান্নার সুর। অভিসম্পাত ধ্বনিত হয়েছিলো প্রতিটি বালুকণার থেকে। নীল আসমান স্তম্ভিত হয়ে নির্বাক তাকিয়ে ছিলো সেদিনের গুলিস্তানের দিকে। শরতের নির্মেঘ আকাশ অসভ্য জন্তু-জানোয়ারের উল্লাসের স্বরুপ দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। গোটা একটি জনসমুদ্রকে পিঁপড়ার মত মেরে ফেলার নারকীয় চেষ্টা দেখে ভয়ে আঁতকে উঠেছিলো পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্য। সূর্য হয়তো গাছের আড়ালে গিয়ে গ্রেনেডের আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলো। ঠিক যেমন চেষ্টা করেছিলাম আমি ওসমানী উদ্যানের আড়ালে সরে গিয়ে।

লেখক: মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন