আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ডি.এল.ও আতিয়ার: এক অসমাপ্ত গল্পের নায়ক!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১০-০২ ২২:০০:০৮

শাকিল জামান ::  যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়- এ এক অমোঘ সত্য। মানুষ যেমন চিরকাল বেঁচে থাকে না, ঠিক তেমনি সরকারি কর্মকতারাও একই কর্মস্থলে সারাজীবন থাকেন না। এটাই নিয়ম, এটাই চলছে, এটাই চলবে। তবুও কিছু কিছু লোকের বিদায় আমাদের অশ্রুসিক্ত করে। কিছু কিছু বিদায় যে পদ্ধতিতে হয় সেটা মেনে নেয়া যায় না। ঠিক এমনই এক নোংরা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলো সদ্য সাবেক হওয়া সিলেট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আতিয়ার রহমানের বদলি। তিনি সিলেটের ডেইরি শিল্পকে অনন্য উচ্চতায় নিতে কাজ করে যেতে চেয়েছিলেন অথচ চক্রান্ত করে মেয়াদ পূরণের আগেই তাকে সরিয়ে দেয়া হলো। একজন ডায়নামিক কর্মকর্তাকে দেয়া হলো তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি হাঁস-মুরগি খামারের সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব!

কিছুদিন পূর্বে একজন সাংবাদিক বড় ভাই গল্প করছিলেন, \"পশু সম্পদ অফিসে আমরা শুধুমাত্র সার্টিফিকেট সত্যায়িত করার জন্য যেতাম। এর বাইরে তাদের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়তো না। সকালে একবার অফিসে এসে ঘন্টাখানেক বসে অথবা সপ্তাহে একবার এসে পুরো সপ্তাহের কাগজপত্র স্বাক্ষর করে চলে যাওয়া, এমনটাই ছিলো পশু সম্পদ অফিসের জন্য নিত্ত নৈমিত্তিক ঘটনা।\" সেই পশু সম্পদ এখন প্রাণিসম্পদ হয়েছে। এর কার্যপরিধি বিস্তৃত হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন জাতের খামার গড়ে উঠার ফলে চাহিদা বেড়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের। সেই চাহিদা মেটাতে এবং নিজেদের চিরাচরিত নিয়মের বাইরে এসে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছেন প্রাণিসম্পদের কর্মকর্তারা। এখনো বেশিরভাগ কর্মকর্তারা খামারিদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে শুধু ফাইলপত্রে স্বাক্ষর দেয়ার গতানুগতিক কাজে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখাকেই তাদের দায়িত্ব বলে মনে করেন। যে কয়জন কর্মকর্তা ব্যতিক্রম, যারা নিজেদেরকে ফাইলপত্রের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে খামারিদের সাথে মিশে গিয়ে সঠিক পথ দেখান তাদের মধ্যে ডা. আতিয়ার রহমান প্রথম সারিতেই আছেন। সিলেটের পিছিয়ে পড়া প্রাণিসম্পদ খাতকে সারাদেশে মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে খামারিদের সাথে নিয়ে তিনি চষে বেড়িয়েছেন সিলেট জেলার ১৩ টি উপজেলায়।

প্রাণিসম্পদ খাতে সিলেটের অবস্থান খুব একটা ভালো ছিলো না। বাণিজ্যিক খামারের সংখ্যা ছিলো হাতেগোনা কয়েকটি। তাদের সাথে আবার প্রাণিসম্পদ দপ্তরের দূরত্ব ছিলো যোজন যোজন। জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর কখন খোলা থাকে, কখন গেলে কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়, এটাই জানতো না খামারিরা। এমন পরিবেশে এসে জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়, সিলেটে যোগদান করেন ডা. আতিয়ার রহমান। বদলাতে থাকে দৃশ্যপট সকাল থেকে বেলা ৫ টা পর্যন্ত প্রাণিসম্পদ দপ্তরে গেলেই দেখা মিলে ডিএলও আতিয়ার রহমানের। খামারিদেরকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। সিলেটের প্রত্যেকটি উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসগুলোকে ঢেলে সাজান। নিশ্চিত করেন জবাবদিহিতা। নিজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সেবা নিশ্চিত করেন।

ডা. আতিয়ার রহমান সিলেটের সকল উপজেলার দুগ্ধ ও গরু মোটাতাজাকরণ খামারিদের নিয়ে গঠন করেন সিলেট ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশন। এরপর থেকেই ডেইরি এসোসিয়েশন ও জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের যৌথ উদ্যোগে নেয়া হয় একের পর এক উন্নয়ন পরিকল্পনা। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাণিসম্পদ দপ্তরের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরীতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ডা. আতিয়ার রহমান। যার ফলশ্রুতিতে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি সিলেট বিভাগের অন্যান্য জেলার খামারিদের নিয়ে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।

ডা. আতিয়ার সিলেটের প্রত্যেকটি উপজেলায় সিলেট ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশনের কমিটি গঠন করতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। এতে উপজেলা পর্যায়ে খামারিরা উদ্বুদ্ধ হয় এবং উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের সাথে খামারিদের সেতুবন্ধন তৈরী হয়। সিলেটে এসে প্রথম তিনি যে বিষয়ের উপর জোর দিয়েছিলেন সেটা হলো- উন্নত জাতের ঘাস চাষ। এজন্য তিনি উন্নত জাতের ঘাসের কাটিং বিতরণ করেন। প্রত্যেকটি উপজেলায় উন্নত জাতের ঘাসের চাষ করতে বলেন যাতে খামারিদেরকে ঘাসের কাটিং সরবরাহ করা যায়। খরা মৌসুমে যখন ঘাসের সংকট হয় তখন ঘাসের বিকল্প হিসেবে সাইলেজ তৈরী করতেও খামারিদের উদ্বুদ্ধ করেছেন ডা. আতিয়ার। অফিস টাইমের পরেও রাত ১২ টা পর্যন্ত তিনি নিজে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন খামারে সাইলেজ তৈরী পর্যবেক্ষণ করেছেন। কোরবানির সময়ে তিনি চষে বেড়িয়েছেন সিলেটের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল। সিলেটের প্রাণিসম্পদকে সগৌরবে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বিভিন্ন সরকারি ফোরামে। হয়ে উঠেছিলেন সিলেটের খামারিদের একজন সত্যিকারের অভিভাবক হিসেবে।

সিলেটে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডেও নিজেকে যুক্ত করেছিলেন ডা. আতিয়ার রহমান। প্রতিবন্ধি ও নির্যাতনের স্বীকার নারীদের আশ্রম কিংবা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুল, সিলেট ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশনের সাথে যৌথ উদ্যোগে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন। সত্যিকারের একজন মানবিক ও দেশপ্রেমে বলীয়ান জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা পেয়ে সিলেট যখন ডেইরি সেক্টর নিয়ে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলো ঠিক তখনই ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে পরাস্থ হতে হলো তাকে। যে প্রাণিসম্পদে অফিসার ভিজিটে গেলে খাম বাণিজ্য চালু ছিলো, যেখানে কাজ না করেও শুধু উপর মহলে খাম পাঠিয়ে চাকরি পাকাপোক্ত করার রেওয়াজ ছিলো সেখানে ব্যতিক্রম আতিয়ার রহমানকে মেনে নিতে পারছিলো না অনেকেই। ষড়যন্ত্র অবশ্য কম হয় নি; অবশেষে পরাজিত হলেন আতিয়ার! আসলে কি একজন আতিয়ারের পরাজয় হলো? নাকি পরাজয় হলো সততার, দেশপ্রেমের?

খালি চোখে আমরা যেটা দেখি তা হলো সিলেটের ডেইরি সেক্টরে ইতিবাচক ধারা প্রবর্তনকারী ডা. আতিয়ার রহমানের এ বদলির ফলে সিলেটকেই পরাজিত করা হলো। সিলেটের ডেইরি শিল্পের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করা হলো। তবে, ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হবে না। ডা. আতিয়ার রহমান খামারিদের মধ্যে যে সচেতনতা তৈরী করে দিয়ে গেছেন, এটাকে পুঁজি করেই ঘুরে দাঁড়াবে সিলেটের ডেইরি শিল্প। যখনই সিলেটের ডেইরি শিল্পের কথা আলোচনা হবে, তখনই উঠে আসবে এক নাম, সিলেটের খামারিদের অন্তরে গেঁথে যাওয়া এক নাম- ডা. আতিয়ার রহমান।

লেখকঃ যুগ্ম আহবায়ক, সিলেট ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশন।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন