আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

কমিউনিস্ট বিপ্লবীনেতা কমরেড দ্বিজেন সোম স্মরণে

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৬-২৭ ২১:১০:৩০

কমিউনিস্ট বিপ্লবীনেতা কমরেড দ্বিজেন সোম স্মরণে
।। এডভোকেট কুমার চন্দ্র রায় ।।
অবিভক্ত ভারতের সময়কাল থেকে এযাবৎকাল পর্যন্ত যে কয়জন কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা শ্রমিক শ্রেণির আদর্শ মার্কসবাদ লেনিনবাদের পতাকাকে প্রতিষ্ঠা করতে সকল রূপের সংশোধনবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন কমরেড দ্বিজেন সোম তাঁদের অন্যতম। আজ থেকে ১৭ বছর আগে ২০০৩ সালের আজকের দিনে কমরেড দ্বিজেন সোম আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন। দিন তারিখ হিসেবে আজ ২৭ জুন ২০২০ তাঁর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশ সময় কমরেড দ্বিজেন সোম চা শ্রমিক ও ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি শ্রমিকসহ বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিক, কৃষক ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের সংগঠন সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বিশ^ব্যাপী করোনা ভাইরাসজনিত মহামারির উদ্ভূত পরিবেশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ মুক্ত শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ কায়েমের জন্য আজীবন লালিত স্বপ্নদ্রষ্টা মহান এ ব্যক্তির ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা নিবেদন হিসেবে তাঁরই জীবনের বিভিন্ন দিক ও রাজনীতি নিয়ে এই লেখার অবতারণা করছি।

কমরেড দ্বিজেন সোম হবিগঞ্জ জেলার সদর থানার অন্তর্গত মাছুলিয়া গ্রামে ১৯২১ সালের ১৪ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল দীননাথ সোম এবং মায়ের নাম হেমানলীনি সোম। নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয় এবং লেখাপড়াও বেশিদূর অগ্রসর হয় নি।। তিনি এক নিকট আত্মীয়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে দোকান কর্মচারি থাকাবস্থায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং অনুধাবন করেন সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যাতীত জনগণের মুক্তি আসবে না। এসব ভাবনায় তাঁর জীবনের মোড় পরিবর্তন হয় এবং ১৯৪১ সালে পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে ম্যালেরিয়া মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়ে এবং ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। তখনকার সময় কমিউনিস্ট পার্টি ত্রাণ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তিনি ঐ সময় প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ^াসের সাথে ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন। অসুস্থ কমরেডদের চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রƒষার জন্য পার্টির প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিকে (জবফ অরফ ঈঁৎব ঐড়সব) তিনি এক বছর কাজ করেন। এরপর পার্টির নির্দেশে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন তথা শ্রমিক সেক্টরের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৪ সালে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক আন্দোলনে অঙ্গীরা শিং এর নেতৃত্বে যে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠে তাতে ইউনিয়নের সহ-সম্পাদক হিসেবে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। এ সময় একটানা ৩৬ দিন ধর্মঘট সংঘটিত হয়। তখনকার সময়ে কমিউনিস্ট পাটির নেতৃত্বে প্রদেশব্যাপী তেভাগা কৃষক আন্দোলন এবং সিলেট অঞ্চলে পার্টির নেতৃত্বে নানকার প্রথা বিরোধী কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের সাথে তিনি অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন। সর্বভারতীয় রেল ধর্মঘটের সহযোগিতায় তৎপরতা চালানোর সময় ১৯৪৯ সালে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৪ সালে কারামুক্ত হন।

১৯৬০ এর দশকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ক্রশ্চেভীয় সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মার্কসবাদ লেনিনবাদের পক্ষে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন এর প্রেসিডেন্ট মহামতি কমরেড স্ট্যালিন এর মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভচক্র ক্ষমতায় এসে মার্কসবাদী-লেলিনবাদী তত্ত্বের বিপরীতে সামনে আনে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’, ‘শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা’ ও ‘শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ’ এর সংশোধনবাদী তত্ত্ব। এই আকস্মিক বক্তব্যে বিশে^র দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণি ও কমিউনিস্ট পার্টিতে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে মনি সিংহ, বারীন দত্তের নেতৃত্বে পার্টির একাংশ ক্রুশ্চেভের নীতি সমর্থন করেন। কমরেড আব্দুল হক, মোহাম্মদ তোহা, সুখেন্দু দস্তিদারের নেতৃত্বে পার্টির অপর অংশ মনি সিংহ এর বক্তব্যের বিরুদ্ধে থিসিস দাখিল করেন। এ নিয়ে মতাদর্শিক প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টি ও পার্টি প্রভাবাধীন সকল গণসংগঠন দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। কমরেড দ্বিজেন সোম কমরেড আব্দুল হকদের বিপ্লবী লাইনকে সমর্থন করে সংগঠন সংগ্রামে ভূমিকা রাখেন।

বিশ^বিপ্লব ও আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে রক্ষার জন্য সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অবাঙ্গালী সামন্ত মুৎসুদ্দিদের সাথে বাঙ্গালী সামন্ত মুৎসুদ্দিদের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে উগ্রজাতীয়তাবাদী জোয়ারের সৃষ্টি করা হলে কমরেড দ্বিজেন সোম ও তাঁর পার্টি এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নকে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী বৃহত্তর সংগ্রামের অংশ ও অধীনস্থ হিসেবে নির্ধারণ করে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করেন এবং শ্রমিক কৃষক জনগণের শত্রু সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা মুৎসুদ্দিপুঁজি বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার লক্ষ্যে সংগঠন সংগ্রাম পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে গত শতকের আশির দশকে মাও সেতুং এর ‘তিনবিশ^ তত্ত্ব’কে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিতর্ক শুরু হলে মাও সেতুং চিন্তাধারা তথা ‘তিনবিশ^ তত্ত্ব’কে সংশোধনবাদী শ্রেণি সমন্বয়ের প্রতিবিপ্লবী তত্ত্ব হিসেবে মূল্যায়ন করে এর বিরুদ্ধে কমরেড আব্দুল হক ও কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের সাথে তিনি দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন এবং আপোষহীন সংগ্রাম পরিচালনা করেন। চীন, কিউবা, উত্তর কোরিয়াকে কেন্দ্র করে প্রবাহমান সংশোধনবাদী ধারার বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান গ্রহণ করেন। কমরেড দ্বিজেন সোম অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি সিলেট জেলা কমিটি এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) সিলেট জেলা কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে জানা যায়।

উল্লেখ্য যে, শৈশবে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের আত্মত্যাগ ও মানুষের প্রতি দরদ দেখে কমরেড দ্বিজেন সোম কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং পার্টির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পার্টির সার্বক্ষণিক সভ্য হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। সিলেট অঞ্চলের অনেক রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু ছিলেন কমরেড দ্বিজেন সোম। তিনি ছিলেন অকৃতদার এবং সকলের কাছে দেলোয়ার ভাই হিসেবে অধিক পরিচিত ছিলেন।

দীর্ঘ ৬৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে প্রায় ৪০ বছর তাঁকে আত্মগোপনে থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে হয়। এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মার্কসবাদ লেনিনবাদ এর লাল পতাকাকে সমুন্নত রাখেন এবং সকল রূপের সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম পরিচালনা করেন। আমাদের মতো নয়াউপনিবেশিক ও আধাসামন্তবাদী দেশে জাতীয় জীবনের দূর্দশা ও সংকটের মূল কারণ সাম্রাজ্যবাদ ও দালালদের নির্মম শোষণ নির্যাতন। আর এই শোষণ নির্যাতন থেকে মুক্তির একমাত্র পথ শোষণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার উচ্ছেদ এবং যা শ্রমিক কৃষক জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে পারে। এই ছিল তাঁর প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার। এ লক্ষ্যে সমগ্র জীবন তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে লড়ে গেছেন তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদই মানব মুক্তির একমাত্র পথ- এই ছিল তাঁর দর্শন।

লেখক: সভাপতি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, সিলেট জেলা শাখা।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন