আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

আমার বাবা আমার বাতিঘর

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৬-৩০ ২০:২২:১৮

আমার বাবা আমার বাতিঘর
।। আহাদ চৌধুরী বাবু ।।

আগামীকাল আমার আব্বার মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৩ সালের ১ জুলাই মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি পরপারে পাড়ি জমিয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে করে ভারত ও সিঙ্গাপুর নিয়ে যাই। চিকিৎসা হয়, কিন্তু আব্বাকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। আল্লাহর ইচ্ছায় তার ডাকে সাড়া দিয়ে ৮০ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান আমাদের বাবা আলা উদ্দিন চৌধুরী।
আব্বা সিলেটের বিয়ানী বাজার উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নে জন্ম গ্রহন করেন। উনার পিতা মরহুম মকম্মিল হোসেন চৌধুরীর ৮ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ২য়। একজন সন্তান হিসেবে বাবার যে বিষয়গুলো আমাদের ব্যক্তি ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে আমাদের মধ্যে প্রভাব পেলে তা হলো একজন প্রখর জ্ঞানসম্পন্ন আধুনিক মানুষ। সৎ মানবিক ও সাংগঠনিক কর্মঠ ও আলোকিত সমাজ বিনির্মাণ, মানবাধিকার ও সম অধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে সরব এক প্লাটফর্ম যা থেকে আমরা বারবার অনুপ্রানিত হয়েছি।

তিনি সামাজিক কুসংস্কারের অন্ধকারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ১৯৫৭ সালে নিজ বাড়িতে প্রতিষ্টা করেন দক্ষিণ দুবাগ বালিকা বিদ্যালয়। পরবর্তীতে যা সরকারীকরণ হয়ে স্থানান্তরিত হয়। অল্প বয়সে জুরি বোর্ডের সদস্য হন। তার সামাজিক যে দায়বদ্ধতা বা শুদ্ধতাকে লালন করতেন তার প্রথম চিন্তা ছিলো জ্ঞান অর্জন, স্কুল প্রতিষ্ঠা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অসম ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যাওয়া। তার শিক্ষা ক্ষেত্রে  সরব অংশগ্রহনের স্বাক্ষী হলো দুবাগ স্কুল ও সিলেটের রসময় মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদে প্রায় চল্লিশ বছর কাজ করা। তৎকালিন সময় সিলেটের জেলা প্রশাসক ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন আর তিনি ছিলেন সহ সভাপতি।

সিলেটের মদন মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পরিচালনা কমিটিতে ছিলেন অনেক বছর। সিলেট ল কলেজ প্রতিষ্ঠা, তিব্বিয়া কলেজের উন্নয়ন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবির পাশাপাশি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী দারুস সালাম মাদ্রাসার সভাপতির দায়িত্বপালন করেন অনেক বছর। সিলেটের প্রাচীনতম খাসদবী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯৭৪ সালে রাতের অন্ধকারে দুষ্কৃতিকারীরা জ্বালিয়ে দিলে তিনি এর পুনঃনির্মাণে এবং অবকাঠামো উন্নয়নে হাত দেন।

শুধু তাই নয় ঐ সময়ের পরে প্রথম স্কুল ড্রেস নিয়ে আসেন। সমাজ কল্যানে মোটা দাগের যে বিষয় সেটি হলো প্রবীণ জনগোষ্ঠির কল্যানে বৃহত্তর সিলেটে একজন রোল মডেল হয়ে উঠেন। তিনি প্রবীণ হিতৈষী সংঘ সিলেটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনিই সিনিয়র সিটিজেন এবং এর যথার্থতা নিয়ে সিলেটে ব্যাপক কাজ করেন। যার প্রমাণ বাগবাড়ীতে জেলা প্রশাসন থেকে জায়গা অধিগ্রহন এবং প্রবীণ হসপিটাল প্রতিষ্ঠা। তার সামাজিক ন্যায় বিচার ও একজন সালিশ ব্যক্তিত্ব হিসেবে সিলেটে উদাহরন ছিলেন।

একজন প্রবীণ রাজনীতিক হিসেবে তার রাজনীতিক কন্সেপ্ট ছিলো প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিয়করন, জনগনের সহজে নাগরিক সেবা গ্রহনে সহজ অংশগ্রহন। তিনি সিলেট শিক্ষা বোর্ড, চা বোর্ড প্রতিষ্ঠা ও সিলেট বিভাগ আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ছিলেন। একজন স্মার্ট সুস্থ চিন্তার মানুষ ছিলেন। ধার্মীক ছিলেন তবে ধর্মীয় গুড়ামী তাকে স্পর্শ করেনি তাকে। তিনি জানার চেষ্টা করতেন। প্রচুর পড়াশুনা করতেন ও লেখতেন। তার হাতের লেখা ছিলো চমৎকার। একজন পরিশ্রমী মানুষ হিসেবে সিলেটের প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার হিসেবে সিলেট জেলা পরিষদ ঠিকাদার ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশন গঠন ও সভাপতি ছিলেন। তার পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও এলজিইডিতে নিবন্ধনকৃত ঐতিহ্যবাহী মেসার্স ফেরদৌস চৌধুরী কন্সট্রাকশনের কর্নধার ছিলেন।

একজন বাবা হিসেবে তিনি আমাদের মানুষ ও মানবিকতা, জ্ঞান অর্জন, পারিবারিক ঐতিহ্য, ঐক্য, সংহতি এবং সততার বিষয়গুলো মননে ও চিন্তায় রোপন করার প্রানান্তন প্রচেষ্টা নিয়েছেন। তার শ্রম ও ঘামের নিরলস অর্জন আমাদের আজকের অবস্থানের প্রেক্ষাপটে দ্যোতি হিসেবে কাজ করেছে। তিনি ছিলেন আলোর জ্যোতি একজন সমাজ সংস্কারক ও বটবৃক্ষ। যিনি আলোকিত সমাজ ও বিশুদ্ধতা বিনম্রতা ও সুন্দরের পুজারী ছিলেন। আমাদের ইন্দ্রীয়গুলোর বিকাশ ও ব্যাপ্তিতে এবং গঠনে এক শিক্ষক  ছিলেন। যার পাঠদান  আমরা অনেকটা দাবী করে বলতে পারি আমরা ভাই বোন পথ হারাইনি। বাবার আর্দশ ভালো মানুষ ও বিশুদ্ধতা ধারণ করে নিজেদের গড়ার প্রানান্তন চেষ্টা চলমান।

আজ মৃত্যু দিবসে মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি আল্লাহ যেনো তাকে উত্তম স্থানে অধিষ্ঠিত করেন। আর সন্তান হিসেবে নিজের প্রকাশটি হলো তিনি ছিলেন আমাদের রক্ষণভাগের অতন্দ্র প্রহরী। প্রথম ভোরের স্নিগ্ধতা মাখা আলোর প্রকাশ। যে আলোর তাড়া ছিলো মক্তব আর স্কুলে যাওয়ার তাগিদ। যেটি মানুষ মানবিক ও বিশুদ্ধতা অর্জনে ছিলো এক নাবিকের পরিশ্রম।

লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন