আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

এক বিষণ্ন রাতের দুঃস্বপ্ন

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৮-২৬ ১৩:১২:০০

শেখ মনজুরুল হক  :: এখনো মনে হয় কামরান ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদটা কোন এক বিষন্ন রাতের দুঃস্বপ্ন। মনে হয় ঘুম থেকে উঠে আবার কথা হবে কামরান ভাইয়ের সাথে, উনি হাসি মুখে ভালোবেসে ভাই বলে সম্বোধন করবেন আর  দুঃস্বপ্নে দেখা মৃত্যুর সংবাদটি মিথ্যা হয়ে যাবে। তবে এটাই যে সত্য কামরান ভাই আসবেন না ফিরে কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া বিস্তৃত কর্ম আমাদের হৃদয়পটে জ্বলজ্বল করবে।

জনতার কামরানকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা হিসেবে স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে মূল্যায়ন করা সমুচিত নয়। এক কথায়, যা কিছু সুন্দর, তার সবকিছুতেই সম্পৃক্ততা ছিল বদর উদ্দীন আহমেদ কামরান ভাইয়ের। তাঁকে নিছক রাজনৈতিক পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ করার অবকাশ নেই। তিনি রাজনৈতিক পরিচয়ের সীমানা ছাড়িয়ে দলমতের উর্ধ্বে ওঠে সিলেটের গণমানুষে প্রীতির পাত্রে পরিণত হয়ে ছিলেন তাঁর সৃজনশীল কর্ম আর মার্জিত আচরণের মধ্য দিয়ে।

প্রয়াত মহান এই মানুষটির কর্মময় জীবনের স্মৃতিচারণ করতে কোন শৈল্পিক বিশেষ, বিশেষণও নিষ্প্রয়োজন, কেননা তিনি সকল বিশেষণের মাত্রা ছাড়িয়ে আজন্ম জনতার মেয়র খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।

১৫ জুন সদালাপী এই মানুষটি আমাদের ছেড়ে যাত্রী হলেন অনন্তকালের সেই শাশ্বত পথের। হাজারো শুভাকাঙ্ক্ষীর মত আমিও খুব আশান্বিত ছিলাম উনি দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে। কামরান ভাই ঠিকই ফিরে আসলেন তবে হেঁটে নয় নিস্তব্ধ অশ্রু সিক্ত জনতার কাঁধে করে নীরব নিথর দেহ নিয়ে। কামরান ভাইয়ের মৃত্যুর একদিন আগেও চিকিৎসকের বরাত দিয়ে তাঁর শারীরিক উন্নতির কথা জানানো হয়েছিল। কিন্তু হাজারো আশান্বিত হৃদয়ের ফিরে পাওয়ার আকুল আকুতির যাবনিকাপাত ঘটল শেষ পর্যন্ত প্রিয় মানুষটির চির প্রস্থানের মধ্য দিয়ে।

কামরান ভাই যে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন এমনটা কারো প্রত্যাশা ছিলনা। তবুও জীবনচক্রের এই চিরন্তন সত্যকে আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে। কামরান ভাইয়ের মত বড় মাপের রাজনীতিবিদকে নিশ্চয় ক্ষণজন্মা বলতে হবে। যেখানেই কামরান ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে, যে পরিস্থিতি নিয়েই তাঁর সাথে যতবার কথা বলেছি ততবারই আমি প্রীতিস্নাত হয়েছি আর বিস্ময়ে অবলোকন করেছি তাঁর অন্তর্নিহিত সত্ত্বাটি।

তৃণমূলের একজন রাজনৈতিক কর্মী থেকে হাটি-হাটি,পা-পা করে তিনি আলোর দ্যুতি ছড়িয়েছেন কেন্দ্র পর্যন্ত।দীর্ঘ রাজনৈতিক পথচলায় আদর্শচ্যূত হননি কখনোই। অহমিকা,দম্ভ,নেতিবাচক কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। কণ্টকাকীর্ণ এই পথচলায় তিনি প্রমাণ করে গেছেন কতটা নির্মোহ আর বড় মনের মানুষ ছিলেন তিনি।

সিলেটের গণতান্ত্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর অগ্রগণ্য ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সিলেটবাসীর জন্য অপরিহার্য।

১৯৭৩ সালে তৎকালীন সিলেট পৌরসভার ওর্য়াড কমিশনার হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় জনতার কামরানের নির্বাচনী পথচলা। এক যুগেরও বেশি সময়কাল ছিলেন পৌরসভার কমিশনার। ৯৫ সালে সিলেট পৌরসভার জনগণ তাঁকে নির্বাচিত করে পৌরপিতা হিসেবে। ২০০২ সালে সিলেট সিটি কোর্পোরেশন গঠিত হলে কামরান ভাই হন ভারপ্রাপ্ত মেয়র।২০০৩ সালে নগরবাসীর ভোটে কামরান ভাই আবার নগরপিতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৪ সালে বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে সিলেটের গুলশান সেন্টারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বিরোধী এক সমাবেশে তিনি বোমা হামলার শিকার হন। অল্পের জন্য তিনি বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান আওয়ামীগ নেতা ইব্রাহীম আর আহত হন অসংখ্য নেতা কর্মী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মিথ্যা মামলায় তাঁকে জেলে যেতে হয়। ২০০৮ সালে কারাগারে বসেই জনতার কামরান সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মত প্রার্থী হয়েছিলেন এবং প্রায় ৮৫ হাজার ভোট বেশি পেয়ে সমগ্র বাংলাদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। তিনি সিলেট শহর ও নগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রায় তিন দশক। টানা দুই মেয়াদ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে মূল্যায়িত হয়েছেন তিনি।

সিলেটের ঐতিহাসিক আলীয়া মাদ্রাসার ময়দানে জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যেকটি জনসমাবেশে ধবধবে সাদা পান্জাবী আর মুজীব কোটের সাথে গোল সাদা টুপি পরিহিত জনতার কামরানের দরদী কন্ঠের বক্তব্যে হাজারো মানুষের মত আমিও বিমোহিত হতাম।কামরান ভাইয়ের শব্দচয়ন আর দরাজ কন্ঠের কৌশলী বক্তৃতা বড্ড মিস করবে পূণ্যভূমি সিলেটের অলি-গলি আর রাজপথ।

কামরান ভাইয়ের হঠাৎ করে অনন্তকালের পথে এই যাত্রাটা আমাদেরকে বেদনাহত করেছে। করোনার এই দুর্যোগময় মুহূর্তে সবাই একসাথে মিলিত হয়ে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর অবকাশ নেই। কষ্টটা এ জন্য আরো বেশি বোধ করছি। কামরান ভাইয়ের বর্নাট্য রাজনৈতিক ও সামাজিক এই পথচলা আগামী প্রজন্মের কাছে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে এ আমার বিশ্বাস।
 
কামরান ভাইয়ের মত বড় মাপের রাজনীতিবিদরা শয়ে শয়ে জন্মান না।তাঁর আত্মজীবনী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

পরপারে ভালো থাকবেন কামরান ভাই।

লেখক: সাবেক ছাত্র বৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক, সিলেট জেলা ছাত্রলীগ


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ২৬ আগস্ট, ২০২০ / মুক্তমত / ডালিম

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন