আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং
আরাফাত হোসেন :: আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যদায় প্রতিষ্ঠা করার ঐতিহাসিক দিন এটি। ১৯৫২ সালের এ দিনটিতে বাংলার ইতিহাসে এমন কিছুই ঘটে গিয়েছিলো যা পৃথিবীতে বিরল। মায়ের কোলে শুয়ে যে ভাষা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, সে ভাষাকে যখন স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছিলো না তখন এই বাংলার দামাল ছেলেরা আপোষে তা মেনে নেয় নি।
রাজপথে, শহরে, বন্দরে সমস্বরে তার ঘোরতর প্রতিবাদ করেছিলো। বিক্ষোভে ক্ষীপ্ত হয়ে প্রতিবাদধ্বনি উচ্চারিত করে আন্দোলনে নেমেছিলো। সেইরকম একটি প্রতিবাদী দিনের সূচনা ছিলো ২১ শে ফেব্রুয়ারি।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে সমগ্র দেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন জোরদার করা হয়। পাকিস্তানি শাসক ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সকল প্রকার মিটিং মিছিল ও সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানে প্রত্যয়ী ছাত্রসমাজ ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের দল "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই " নামক প্লেকার্ড হাতে নিয়ে সমস্বরে স্লোগান দিয়ে রাজপথে বেরিয়েছিলো। তখন পুলিশ সেই মিছিলে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। মুহূর্তে মিছিল ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। রাজপথ স্তব্ধতায় রূপ নেয়। স্লোগান দেয়ার তাজা প্রাণগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
এতে সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার সহ অনেকে নিহত হয়। আজ সেই ২১ শে ফেব্রুয়ারি, যে দিনে দামাল ছেলেরা মাতৃভাষার জন্য নিজের জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি।
এই শহীদদের স্মরণে তৈরী হয়েছে শহীদ মিনার। বৎসরের একটি দিন ২১ শে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে আমরা প্রভাতফেরীতে যাই। হাতে শিশিরভেজা ফুল,গায়ে সাদা কালোর শোকচিহ্নের পোষাক, আর খালি পায়ে এক এক করে এগিয়ে যাই শহীদ মিনারে। কণ্ঠে থাকে প্রভাতফেরীর গান- " আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১ শে ফেব্রুয়ারী , আমি কি ভুলিতে পারি " সেটি গাইতে গাইতে আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসি। আজ তা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাড়িয়েছে।
নির্ভুলভাবে এ সংস্কৃতি, এ ভাষার চর্চা আমাদের করা উচিত। এ ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি প্রদানের পটভূমি কোনো সহজ সাবলীল ছিলো না। এর পিছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস।
২১ শে ফেব্রুয়ারি এখন আর শুধু আমাদের মাতৃভাষা দিবস নয়। প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারী সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে ' আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) এর সাধারণ পরিষদের ৩০ তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশ সহ ২৭ টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতভাবে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কোর প্রস্তাবে বলা হয়, " ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্যে বাংলাদেশের অনন্য ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং ১৯৫২ সালের এই দিনের শহীদদের স্মৃতিতে সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে রাখতে একুশে ফেব্রুয়ারীকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারী ইউনেস্কোর ১৮৮ টি সদস্য দেশ এবং ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হবে।"
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশ্রিত করে অন্য ভাষার অবাধ ব্যবহারের পরিচর্যা চলছে। এ মিশ্র ভাষার ব্যবহার করা যা এক ধরণের সৌখিনতায় রূপ নিয়েছে। সাধু, চলিত, আঞ্চলিক তার মধ্যে আবার ইংরেজী যুক্ত করে প্রকাশ করা হচ্ছে মনের ভাষা। ভাষার এ বিকৃত রূপ যা মোটেও কাম্য নয়। ইদানিং আমরা লক্ষ্য করি বিভিন্ন নাটক ও টিভি সিরিজেও ভাষা ও সাহিত্যের কোনো শৃঙ্খলা থাকছে না। বর্তমানের তরুণরা ভাষার ব্যাপারে এতো বেখেয়াল কেনো তার উত্তর বহু অনুসন্ধানেও খুজে পাইনি। টিভি সিরিজের মতো এ ধরণের শক্তিশালী একটি প্রচার মাধ্যমও যদি এমন দায়িত্বহীনের মতো প্রচারণা করে তবে এ দেশের মানুষ খুব দ্রুতই সগৌরবন্বিত এ ভাষার মর্যাদা হারাতে বসবে।
ভাষা একটি দেশের সাংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। আর এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে শক্তিশালী হাতিয়ার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হলো- সকল মাতৃভাষাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া, যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া, বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা, দুর্বল বলে কোনো ভাষার ওপর প্রভুত্ব আরোপের অপচেষ্টা না করা, আর সকল ভাষার প্রতি সমান মর্যাদা প্রদর্শন করা। এ দিবসে সকল মানুষ নিজ ভাষাকে যেমন ভালোবাসবে তেমনি অন্য ভাষাকেও যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করবে।
বায়ান্নোতে ভাষা জন্য আন্দোলন করে, বাঙালি জাতি নিজের রক্ত দিয়ে সারা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো নিজ ভাষাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসার এক মন্ত্র। এ বিষয়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের ও মর্যাদার। আমাদের উচিত তা সগৌরবে লালন করে এ ভাষাকে চর্চা করে সাহিত্যে গল্পে গানে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করা।
মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের প্রেরণাকে লালন করে আত্মমর্যাদায় চির উজ্জীবিত হয়ে এ সমাজের তরুণ তরুণী যারা আগামী পৃথিবীর শাসক তারা চলুন, সততায়, নিষ্ঠায়, সংগ্রামে সত্যের পিছনে ঐক্যতায় ছুটে চলি। তাহলে যেকোনো লক্ষ্যের বিজয় একদিন হবেই।