আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

রশিদপুরে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা : চলে গেলেন প্রিয় কামাল ভাই

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২১-০৩-০৪ ১৮:০০:৪৮

ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল :: চলে গেলেন প্রিয় কামাল ভাই। সদা হাস্যজ্জ্বল, ধার্মিক, খোলামনের প্রিয় মানুষটি আজ পৃথিবীতে জীবিত নেই। দক্ষিন সুরমার রশীদপুরে মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় আরও অন্যান্যদের সাথে আমরা হারালাম একজন নিবেদিত প্রাণ মানুষটিকে। সকালে ফজরের নামাজ আদায় করে বাসার সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে এনা পরিবহনের বাসে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে সকাল ৬.৩০ মিনিটে রওয়ানা হন। টিকিট নাম্বার D1  অথবা D2, অর্থাৎ চতুর্থ সারিতে। হঠাৎ খেয়াল করলেন ডান দিকের A1  অথবা A2  সিটটি খালি রয়েছে। গল্পরসিক এবং প্রকৃতিপ্রেমী মানুষটি সম্ভবত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য নিজ সিট থেকে উঠে A1 অথবা A2 অর্থাৎ প্রথম সাড়িতে বসেছিলেন। সমানের সারিতে বসার ফলে দূর্ঘটনার প্রভাব বেশী মাত্রায় তাঁর উপর পরে। D1  অথবা D2, সিটে পরবর্তীতে যারা বসেছিলেন শুনেছি তারা বেঁচে আছেন। জানাযার নামাজ পড়ার পর শাহ কামাল ভাইয়ের নিথর দেহটিকে একবার দেখলাম। সেই আগের মতই সুন্দর। চোখ দুটি কিছুটা খোলা এবং সেই হাস্যজ¦ল মুখমন্ডল। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর দান করুন এই কামনা করি।

স্মৃতির পাতায় রয়েছে কামাল ভাইয়ের সাথে বেশ কিছু ঘটনা। নিরঅহংকার, হাস্যরসিক, ধার্মিক মানুষটির সাথে তাবলীগ জামাতে ৩ দিন থাকার সৌভাগ্য হায়েছিল ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার বড় মসজিদে। খুব কাছ থেকে দেখেছি কামাল ভাইকে। হাস্যরসিক কামাল ভাই বিভিন্ন গল্প এবং ঘটনা বর্ণনা করে আমাদের আনন্দ দিতেন। কিছু দিন আগের একটি ঘটনা। করনাকালীন পরিস্থিতিতে সরাক্ষন ঘরে থাকতে অনেক সময় ভালো লাগেনা। তাই একদিন বৈকালিক ভ্রমণে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যান্ডবল গ্রাউন্ডে দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি কামাল ভাই তাঁর ৮ বছরের শিশুপুত্র কে নিয়ে ফুটবল খেলার বল সহ হন্ডবল গ্রাউন্ডে এসেছেন। দেখা হতেই হাস্যজ¦ল মুখে বললেন “স্যার কেমন আছেন? ফুটবল খেলবেন নাকি?” ডায়াবেটিস রোগী হওয়াতে ভাবলাম খেলার মাধ্যমে একটু পরিশ্রম হলে ভালোই হয়। বললাম “চলুন কয়েকটা প্যানাল্টি কিক মারি। দেখি আপনি কেমন গোলরক্ষক! “কামাল ভাই দক্ষতার সাথে কয়েকটি প্যানাল্টি প্রতিরোধ করলেন। পরবর্তীতে ওয়ান টু ওয়ান ফুটবল খেললাম। ম্যাচের প্রায় অন্তিম মুর্হর্তে ব্যাক ফ্লিকে একটি গোল করলাম। কামাল ভাই মজার ছলে বললেন “স্যার এমন গোল কোনদিন হজম করিনি।” আজ এসবই স্মৃতি। উল্লেখ্য, আখালিয়া নিবাসী কামাল ভাইয়ের দোকান আছে সিলেট নগরীর ব্লুওয়াটার মার্কেটে।

একটি কথা আছে “একটি সড়ক দূর্ঘটনা; সারা জীবনের কান্ন”। সড়ক দূর্ঘটনা রোধে অনেক বিষয়েই আলোচনা করা প্রয়োজন। দূর্ঘটনারোধে অনেক সময় মহাসড়ক প্রশস্তকরণের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এটি গুরুত্বপূর্ণ। দূর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে এবং দুর্ঘটনা নিরসনে অথবা কমিয়ে আনতে মনস্তাত্বিক বিষয়টি খুবই গরুত্বর্পূ। যাত্রীবাহী অথবা পণ্যবাহী পরিবহণের বিশেষত চালকগণের এবং হেলপারগণের মনস্বাত্বিক বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করা প্রয়োজন।
প্রথমত, পরিবহন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগীতা বিরাজ করার ফলে বেশীর ভাগ পরিবহণগুলোকে মাত্রাতিরিক্ত গতিতে বাস চালাতে দেখা যায়। এটি খুবই বিপদজনক। অনেক সময় চালকগণকে (বিশেষত যুবক শ্রেণীর চালকগণকে) কোন কারণ ছাড়াই স্বভাবসুলভ কারণে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাস/ট্রাক চালাতে দেখা যায়। এ স্বভাবের পরিবর্তন প্রয়োজন এবং পরিবহন মালিকগণকে দক্ষচালকের পাশাপাশি ধীরস্থির মনোভাবাপন্ন চালকগণের সন্ধান করা প্রয়োজন এবং চালকগণের সাথে ঈড়ঁহংবষরহম এবং গড়ঃরাধঃরড়হ এর মাধ্যমে তাদের ধীরস্থির মনোভাবাপন্ন করা প্রয়োজন। অন্যথায় এ ধরণের চালককে পরিবহণ চালাতে দেয়া মোটেই কাম্য নয়।

দ্বিতীয়ত, প্রায়ই দেখা যায়, বাসের যাত্রীগন দ্রুত গন্তব্যে পৌছার লক্ষ্যে ড্রাইভার/চালকে কে চাপ দিতে থাকেন। এটি বিপজ্জনক। চালকগণকে চাপ  সামলে নিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ী চালানোর জন্য উদ্বদ্ধ করা প্রয়োজন। এই দায়িত্বটি মূলত পরিবহন মালিকদের। Counseling  এবং Motivation  করার জন্য সরকারী এবং বেসরকারী উদ্যেগে মূলত বাস এবং ট্রাক চালাকগণের সাথে চৎড়মৎধস করা প্রয়োজন যাতে চালকগণ নিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ী চালাতে উদ্বুদ্ধ এবং বাধ্য হন এবং যাত্রীগণের অনৈতিক গতি বৃদ্ধির চাপ সামলে মাথা ঠান্ডা রেখে নিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ী চালাতে পারেন।


তৃতীয়ত, সড়ক দূর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ঝুকিপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক ওভারটেকিং। রশিদপুরের মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনার প্রধান কারণ হলো- সংঘর্ষে পতিত দুটি প্রতিষ্ঠানের বাসের একটি বাস তৃতীয় অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বাসকে মহাসড়কে অপ্রয়োজনীয় ও ঝুকিপূর্ণ গতি বৃদ্ধির মাধ্যমে ওবারটেকিং করতে চাওয়া। তৃতীয় বাসটি উক্ত প্রতিষ্ঠানের বাসটিকে ওভারটেকিতে করতে সুযোগ দিতে চায় নি। তৃতীয় বাসটি ওভারটেকিতে এর সুযোগ না দেয়া সত্তে¡ও মনোস্তাত্বিক (চযুপযড়ষড়মরপধষ) কারণবসত জোড়পূর্বক ওভার টেকিং করতে যাওয়াই উক্ত মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে জানা যায়। চালকগনের এ ধরনের ঝুকিপূর্ণ মানসিকতা বন্ধ করা একান্ত প্রয়োজন। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। কামাল ভাইয়ের মত আমরা আর কাউকে হারাতে চাই না।

লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম-৬

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন