আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

পুত্রধনের বিয়ের স্বাদ ও বর্ণবাদ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২১-০৩-০৭ ১৯:১২:৩৪

ফারজানা ইসলাম লিনু :: বেশ ক'বছর আগের ঘটনা। আমার পুত্রের বয়স তখন কুল্লে চার বছর। সেই সময় আমার ভাইপো সজিবের বিয়ে হয়েছিলো। সামারের ছুটি থাকায় বিয়ে উপলক্ষে সজিবরা ঢাকা থেকে আসার আগেই আমরা বাড়িতে গিয়ে হাজির।

ভ্যাকেশনের অর্ধেকটা সময় বাড়িতে কেটে গেলো। কিছুটা বুজ হওয়ার পর এই প্রথম এতো কাছ থেকে পুত্রের বিয়ে খাওয়া। খুব আরামসে বিয়ের সব অনুষ্ঠানের কুটিনাটি আনন্দ উপভোগ করতে করতে পুত্রের মাথায় বিয়ের ভুত চেপে বসে।

দিনে দিনে এই বিয়ে ভুতের যন্ত্রণা আরো প্রবল হয়। পুত্রের সজিব ভাইয়া বউ নিয়ে হানিমুনে যায়, কক্সবাজারে বেড়ায়। রঙ ঢঙয়ের ছবি ফেসবুকে পোস্টায়। মায়ের পাশে বসে এইসব দেখে পুত্রের আর তর সয়না। "লাইফ ইজ বিউটিফুল".. তার এক দফা এক দাবি সে এইবার বিয়ে করবেই।
এই বাচ্চাকালে বিয়ে করাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত এই নিয়ে পুত্রের মায়েরও তেমন মাথাব্যথা নেই।

আজাইরা ত্যাঁদড়ামির জন্য মহিলাতো কয়েক কাঠি সরেষ। উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত স্বভাব। শিশু পুত্রের বিয়েতে অরাজি না হয়ে মা উলটা জানতে চায় পুত্রের কোন পছন্দ আছে কিনা।

পুত্র সাফ সাফ জানিয়ে দেয় তার কোন পছন্দ নেই। মায়ের পছন্দে বিয়ে করবে, তবে বউ হতে হবে অনিন্দ্য সুন্দরি। অনিন্দ্যসুন্দরের বর্ণনায় বরাবরের মতো গাত্রবর্ণ প্রাধান্য পাচ্ছে। একেবারে দুধে আলতা গায়ের রঙ হবে কইন্যার।পুত্রের বিবাহ সম্পর্কিত চাহিদার যাবতীয় শর্তে মা তার একবাক্যে রাজি।

মায়ের আশকারা পেয়ে পুত্র বিবাহের পরিকল্পনার পাশাপাশি বিয়ের দাওয়াত, হানিমুন সবকিছুর একটা খসড়া তৈরি করে। স্কুলে যাওয়ার সময় আমাকে সাবধান করে দেয়, মা'জি শুনেন আপনি মিসদের সাথে আমার বিয়ের গল্প করিয়েন না। আপনি তো আবার সবকিছু মিসদের বলে দেন। আমার কিন্তু শরম লাগে।

আমি বললাম, এইটা কেমন কথা বাজান? একমাত্র পুত্রের বিয়ে দিবো আর নিজের কলিগদের বলবো না, তা কি করে হয়? পরে সবাই আমাকে বলবে, কিতা গো লুকাইয়া পুয়া বিয়া দিলাইলায় আমরারে কইলায় না?

পুত্র বললো, আমি কিন্তু সবাইকে বিয়ের দাওয়াত দিবো না। বেছে বেছে কয়েকজনকে দিবো।

পুত্রের এমন কথায় আমি কিছুটা চটে যাওয়ার ভাণ করে বললাম, কাকে বিয়ের দাওয়াত দিবো, না দিবো সেটা কি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে? আমরা আমাদের গুষ্টি কুটুম, আত্মীয় পরিজন রেখে একমাত্র পুত্রের বিয়ে দিবো না।

এইবার পুত্র তার দাওয়াত সম্পর্কিত আসল গোমর ফাঁস করলো। মাথা চুলকে চুলকে বললো, আমি সব সুন্দর মানুষদের বিয়েতে দাওয়াত দিবো। কালো রঙের মানুষদের বরযাত্রী নিবো না।

আমার তো মাথায় হাত। এই ছেলে বলে কী! পুত্র তার সিদ্ধান্তে অনঢ়, সে তার চাচাতো ভাই তায়্যিবকে দাওয়াত দিবে না একই কারণে। কিন্তু তায়্যিবের মা বলতে পুত্র তার বড় মা কে দাওয়াত দিবে।

ঘরের মানুষ ছাড়া অনিন্দ্য সুন্দরি সেজো নানু, রূপসী মেজো নানু, পুত্রের মেজো ফুপু, দিদন এইরকম বেছে বেছে একটা লিস্ট করা হয়েছে। দাওয়াতির লিস্ট শুনে বুঝলাম অনেককেই বাদ পড়েছেন অতিথির তালিকা থেকে।

সাড়ে সর্বনাশ! একমাত্র পুত্রের বিয়েতে সবাইকে দাওয়াত না দেয়ার অপরাধে আমাকে ঘরে বাইরে রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, সমাজচ্যুত হতে হবে।

পুত্রের কাছে সবিনয়ে জানতে চাইলাম, বাপধন কালো মানুষের প্রতি তুমি এতো বিরাগ কেন?
পুত্র আমার মাথা নিচু করে বললো, আমি নিজেও কালো। এখন যদি কালো কালো মানুষের সাথে নিয়ে বিয়ে করতে যাই তাহলেতো নতুম বউ রাগ করবে।

পুত্র সেই বয়সেও ভালো করে অনুধাবন করেছে ছেলেরা ফর্সা বউ আর মেয়েরা ফর্সা বর পছন্দ করে। আমি তখনো বিষয়টা নিয়ে পুত্রের সাথে স্বভাবসুলভ মস্করা করে যাচ্ছি।

পুত্রকে বললাম, তোমার বিয়ের তারিখটা চার সপ্তাহ পেছাতে হবে। যদিও কনে দেখা হয় নাই, কিংবা কনের কোন খবরও নাই। সিলেটি ভাষায় যাকে বলে, "আলা লগে মুলা নাই পুবে দি দুয়ার".

যাই হউক- পুত্রের আবার বিয়ের খুব তাড়া। বিরস বদনে জিজ্ঞেস করলো, কেন, চার সপ্তাহ কেন?

পুত্রকে বুঝিয়ে বললাম- গায়ের রঙ কালো হওয়ার কারণে পরিবার,আত্মীয় কুটুম্বের অনেকেই বিয়ের দাওয়াত থেকে বাদ যাবেন। তাই ভেবে রেখেছি বিয়ের কার্ডের সাথে একটা করে ফেয়ার এন্ড লাভলী ফেয়ারনেস ক্রিম উপহার পাঠাবো। ক্রিম মেখে চার সপ্তাহে ফর্সা হয়ে সবাই বিয়েতে আসবে। আমাদের খরচ কিছুটা বাড়বে, তবুও গুষ্টি কুটুমদের সাথে নিয়েই পুত্রের বিয়ে দিবো।

এখনতো পুত্রের বায়না, মা'জি শুনেন আমাকেও একটা ফেয়ার এন্ড লাভলী এনে দেন, আমিও সুন্দর হবো।

বলাবাহুল্য জন্মের পর থেকেই গাত্রবর্ণ নিয়ে আমার পুত্র মহা ফাপরে আছে। প্রথম দেখাতেই বর্ণবাদী মানুষের জিজ্ঞাসা, ই কালা পুয়া কই পাইছো?
প্রথম দিকে আমি নিজে মজা নিলেও কিছুদিন পর টের পেলাম পুত্র তার গায়ের রঙ নিয়ে হিন্মন্যতায় ভোগে। গায়ের রঙ ফর্সা করার বিভিন্ন তদ্বির টুটকা সে লুকিয়ে লুকিয়ে করে।

এখন সে অনেক বড় হয়েছে। বিয়ের ভুত তার মাথা থেকে ধপাস করে নেমেছে। সেদিনের এইসব গল্প শুনলে সে খুব শরমিন্দা হয়। আমাকে অনুনয় করে বলে, মা, এইসব গল্প আপনি কাউকে বলবেন না।আমার শরম লাগে।

বিয়েশাদির চিন্তা বাদ দিলেও রঙ ফর্সা করার চিন্তা তার মাথা থেকে যায় নি। বাথরুমে ঢুকে মা বোনদের রূপচর্চা সামগ্রী সে দেদারসে লাগায়। এইসব জিনিসের অপব্যবহারের কারণে সে ফর্সা হওয়ার বদলে আরো কালো হয়ে যেতে পারে, এই বলে তারে রূপচর্চা থেকে বিরত রেখেছি বহু কষ্টে। তাও সে আমাকে অনুরোধ করে, মা সেরাবি ফেসওয়াশ এনে দিয়েন তো।

আমাদের বর্ণবাদী সমাজে ছেলেদের গায়ের রঙ দৃশ্যত কোন ম্যাটার করেনা। তবুও আমরা অবলীলায় কাউকে বলি, তুই একটা কাইল্যা, তরে বউ দিতো কে?

মানুষকে গালি দেওয়ার সময়ও কালা পাঠা, কালা মাংটা, কালা মেখরা, কাল ভৈরব বলি। সবগুলো বিশেষন অতীব অপমানজনক।
অভিনেত্রী সুমাইয়া শিমুর বিয়ের পর তার স্বামীর গায়ের রঙ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কি পরিমাণ নোংরামি হয়েছিলো তা তো সবার মনে আছে।
আমাদের এই বিরুদ্ধবাদী সমাজে ছেলেদের গায়ের রঙ নিয়ে যেখানে এতো চুলকানি সেখানে কালো মেয়েরা কি অবস্থায় আছে তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?

বিয়ে বাড়িতে গেলে প্রথম প্রশ্ন, কইন্যা সুন্দর? দামান্দ সুন্দর নি? কইন্যা দামান্দে মিল খাইছেনি?

বাহ্যিক সুন্দরের বিচারের মিল না হলে বিয়ের মজলিসেই কানাঘুষা, নিশ্চয়ই কোন সমস্যা আছে, নইলে পাতিলের তলার ছালি ইগুরে বিয়া করতো কেনে?

সেদিন আমার ভাসুরের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে এক মহিলা খুব চেপে ধরেছেন উনার ভাইয়ের জন্য একটা সুপাত্রী দিতে। আমি যত বলি আমার পরিবারে বিবাহ উপযুক্ত মেয়ে নেই তিনি তত মরিয়া। বার বার এক কথা, কোন দাবি দাওয়া নাই, খালি কইন্যা বেটি ফর্সা হইতো। বউ কালা হইলে বাইচ্চা কাইচ্চা কালা হইবো।

মহিলার সাথে কথা বলতে আর ইচ্ছে করে না। মনে মনে বলি, বাচ্চা-কাচ্চা কালো হলে সমস্যা কী?

হায়রে আমাদের দৈন্যতা, একবিংশ শতকেও আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন নেই। শত শত বছর ধরে সাদা চামড়ার গোলামি করেও সাদার প্রতি প্রীতিটুকু গেলো না। তাইতো আমাদের দেশে ফেয়ার এন্ড লাভলি সর্বাধিক বিক্রিত ফেয়ারনেস ক্রিম। আমাদের ভাই বেরাদররাও ফেয়ার এন্ড লাভলি মেনজ একটিভ পকেটে নিয়ে ঘুরেন।

ফ্যাক্ট : সর্বাধিক জনপ্রিয় দৈনিক প্রথম আলোর ফ্যাশন ম্যাগাজিন নকশা পাতার এক শিরোনাম, "কালো, তবুও সুন্দর", নিয়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে ফর্সা কালোর জগৎ।

(লেখাটি লেখিকার ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত)


সিলেটভিউ২৪ডটকম / মুক্তমত / ডালিম

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন