আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

আমার শিক্ষক মৌলভী সৈজ্জাদুর রহমান

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৮-১৬ ০০:৩৪:১৮

মো. এনামুল কবীর :: কত আর বয়স হবে! ৬০, ৬১ বা বড় জোর ৬২, এ বয়সেই চলে গেলেন আমাদের প্রিয় ‘হুজুর’। অবশ্য বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরা তাকে ‘মোল্লা স্যার’ বলেই ডাকতেন। আর আমাদের এলাকায় তাঁর অবসরের কয়েক বছর পরেও ‘মোল্লা স্যার’ বলতে সবার সামনে যে মানুষটির চেহারা ভেসে উঠতো, তিনি মৌলভী সৈজ্জাদুর রহমান। বিয়ানীবাজারের আছিরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যলয় ও কলেজের সাবেক সহকারি শিক্ষক। যখন সরকারি হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছর, তখন এই বয়সে যে কারও মৃত্যু, অকাল মৃত্যুর আওতায়ই পড়ে। আমাদের প্রিয় মোল্লা স্যারও অকালেই চলে গেলেন জীবনের ওপারে।

আজকাল যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চ শিক্ষার মোড়কে ঢাকা ইতর প্রজাতির কিছু কিছু মানুষ ঢুকে পড়ছে, তখন আমাদের শিক্ষকগণকে সোনার মানুষ বলেই মনে হয়। তাঁরা শাসন করতেন ঠিকই, কখনো ইতরামি করতেন বলে শুনিনি। অন্তত আমার শিক্ষকবৃন্দের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে ১শ’ ভাগ নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি। সম্প্রতি আমার এলাকার একটি প্রতিষ্ঠানে তেমন একটা ইতরের দেখা পেয়েছি আমি, যে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক এমন কি মহিলা সহকর্মিদের সামনেও অনায়াসে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে স্বচ্ছন্দে। আরও তথ্য সংগ্রহ চলছে, বিধায় আপাতত তার পরিচয় প্রকাশ করছিনা।

বলছিলাম মোল্লা স্যারের কথা। ১২ জুলাই ভোরের দিকে তিনি সিলেটের একটি বেসরকারি হাসাপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইনাইহি রাজেউন)। বিয়ানীবাজারের দাসউরা গ্রামে জন্ম নিলেও তিনি পুরোদস্তুর আছিরগঞ্জের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন আমাদের স্কুলে শিক্ষকতার সুবাদে। আমি ঠিক জানিনা, কোথায় তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল, তবে বছরের পর বছর ধরে তিনি আছিরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় তথা এলাকায় ছিলেন, সবার প্রিয় ‘মোল্লা স্যার’ হয়েই। ছাত্রছাত্রীতো বটে, ব্যাবসায়ী এমনকি এলাকার সর্বস্থরের মানুষের কাছেও তিনি ছিলেন পরম শ্রদ্ধার ‘মোল্লা স্যার’। ৮৭ সালে আছিরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির পর আমরা যে ক্লাসের অপেক্ষায় আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম, সেটি হচ্ছে ইসলাম শিক্ষা। মোল্লা স্যার আসবেন, ক্লাস নেয়ার পর একটু গল্পটল্পও হবে, এই আশায়।

মোল্লা স্যার ক্লাসে আসতেন, পড়াতেন এবং সত্যি সত্যিই নানা গল্পও করতেন। গল্পটা হতো ক্লাস নেয়ার শেষে। তবে নির্ধারিত সিলেবাস শেষে যখন রিভিশন চলছে, তখন কিন্তু নানা বিষয়ে আমরাই গল্প জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। সেটি অবশ্য এইট নাইনে উঠার পর। মোল্লা স্যার আমাদের নিরাশ করতেন না, নানা গল্প তিনি করতেন ঠিকই, কিন্তু গল্পের শেষ ম্যাসেজটা ঐ আর ১০ জন আদর্শ শিক্ষকের মতোই যা হতে পারে তাই হতো আরকি! মানে, জীবনটাকে গড়ে তুলতে হলে লেখাপড়ার গুরুত্ব।

মোল্লা স্যারের কিছু কিছু কথা স্কুলের বাইরে আমাদের নিয়মিত চর্চার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এমনকি যখন এই ৪৫ এর পথধরে এগিয়ে যাচ্ছি জীবনের চূড়ান্ত পরিণতির দিকে, তখনও তা মাঝে মাঝে আপনাতেই বেরিয়ে আসে হৃদয়ের গভীর থেকে। যেমন ‘ফুয়াইন অমুক অইযাও’, ‘ধ্যানে স্নান, স্নানে ভোজন, এক সাথে ৩ কাম করে কোন জন’, ‘বওরেবো’ বা ‘এ বেটিন, ৩ ফুড়ি এখানো অইলে কিতা অয়, জানোত..বাজার বয়’।

কথাগুলোর একটু বিশ্লেষণ জরুরী মনে করছি। আমাদের মধ্যে যারা একটু বেশি দুষ্টামি করতাম বা পড়া পারতামনা, তাদের উদ্দেশ্যে মোল্লা স্যারের বিশেষ উপদেশ ‘ফুয়াইন অমুক (উপরের ক্লাসের একজন ভালো ছাত্রের নাম) অই যাও। অমুক অই যাও ফুয়াইন, জীবন গড়িলিবায়’। কিন্তু আমরা তা মানতে না পেরে ফিসফাস কানাঘুঁষা বা তাঁকে ফাঁকি দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়তাম। কারণ, যে ছাত্রের উদাহরণ তিনি দিচ্ছেন, ঐ ছাত্রটি বয়সের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যে দুষ্টামি, হাসি গান খেলা-ধুলা, এসবের ধারে কাছেও তিনি নেই! তিনি বাড়ি-বাজার (পড়া) মসজিদ আর পড়া এবং পড়াশোনাতেই রীতিমতো শহীদ। তো এমন জীবনগ্রহনের কথা শুনলে আমাদের মতো অশান্ত, গান-নাটক-সিনেমা আর খেলাধুলা পাগলেরা হাসি সামলাতেই পারতামনা। কিন্তু মোল্লা স্যার সহজ সরল মানুষ। তিনি মনে করতেন ‘অমুক’ হলেই বাচ্চারা ঠিকমতো জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে, অতএব সেই উপদেশ দিতে কুন্ঠিত হবেনইবা কেন?

ধরুন ক্লাসের তিনি পড়াচ্ছেন আর আমরা দরজা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছি, বা পেছনের দিকে কেউ অন্যমনস্ক হয়ে গেছে বা দুয়েকজনের মধ্যে ইশারা-ইঙ্গিতে দুষ্টামি চলছে, মাঝে মাঝে বেতের বাড়ি দু’য়েকটা জুটলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপদেশ, ‘ও বেটা, ধ্যানে স্নান, স্নানে ভোজন, একসাথে ৩ কাম করে কোন জন’ এই ফইর (ধাঁধাঁ) অর্থ কিতা?’ যে জানে সে বলার জন্য হাত তুললেই তার প্রতি মোল্লা স্যারের চরম বিরক্তি-‘বওরেবো, তুমি বও’। তারপর তিনি নির্দিষ্ট ছাত্রটি পারলে তার কাছ থেকে জবাব আদায় করতেন, না পারলে নিজেই বলে দিতেন, মাছ রাঙা, মাছ রাঙা। ফুয়াইন মাছরাঙা লাখাইন ধ্যান ধরো, তেউ স্নান অইব, লগে ভোজনটাও অইজিবো। জীবন গড়িলিবায়।

কেউ যদি কিছু অতিরিক্ত কথা বলার চেষ্টা করতো, তাহলেও তিনি চরম বিরক্তি প্রকাশ করতেন ভদ্রতাসূচক উক্তি দিয়ে ‘বওরেবো’। আর ছাত্রীদের ওদিক থেকে মাঝে মাঝে গুঞ্জনের ঢেউ তীব্র হয়ে উঠলেও মোল্লা স্যারের বিরক্তি ‘ও বেটিন, ৩ ফুড়ি এখানো অইলে কিতা অয়-বাজার বয় বুচ্ছ, বাজার বয়।’ তাঁর হাতে একটা বেত নিয়ে যদিও আসতেন, কিন্তু সেটি ব্যবহারের বদলে এইসব ওজনদার কথা দিয়েই তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতেন, তবে কখনো কখনো সেটিও ব্যবহার করতে বাধ্য হতেন। আমরাতো আর কম দুষ্টা ছিলাম না! মোল্লা স্যার আরও কতসব চমৎকার কথা বলতেন!

ইসলাম শিক্ষা পরীক্ষা শুরুর দিকে তাঁর ব্যাস্ততা খুব বেড়ে যেতো দেখতাম। কারণ, সেকালে কুমিল্লা থেকে যেসব প্রশ্নপত্র ডাকযোগে আসতো, সেগুলোতে প্রায়ই সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন করে বসত! তো মোল্লা স্যার ব্যাস্ত হবেন না কেন? ছাত্ররা কি লিখবে? দ্রুত পরীক্ষার হলে হলে গিয়ে তিনি সিলেবাসের ভেতরের প্রশ্নগুলো সাজিয়ে দিতেন। আর এসএসসি পরীক্ষায় কেউ ইসলাম শিক্ষায় লেটার মার্ক (৮০) পেলে তাঁর সেকি তৃপ্তি! অন্তত সপ্তাহ ১০ দিন ক্লাসে ঢুকেই কোন না কোনভাবে ঐ প্রসঙ্গ চলে আসতো। ‘অয় অয়, আমার সাবজেক্টো লেটার মার্ক পাইতনা কেনে বা, দেখছো?’ এমনভাবে কথাটি বলতেন, যেনো ঐ ছাত্র লেটার পায়নি, পেয়েছেন তিনি নিজে। শিক্ষার্থীর অর্জনে শিক্ষকের যে কি বিশাল প্রাপ্তি ঘটে, মনে হয় মোল্লা স্যারের মতো আর কেউ তা উপভোগ করেননি কোনদিন।

২০০৯ সালে আমার বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ছে। বিয়ানীবাজারের তিলপারা বা নালবহর কোথাও থেকে মোল্লা স্যার বরযাত্রীদের গাড়িতে উঠছেন, এমন একটি দৃশ্য প্রায়ই চোখে ভাসে। তারপর বরের আসনে বসেও কোন এক খাবার টেবিলে তাঁকে দেখছি বলে মনে পড়ছে।

মাঝে মাঝে বাজারে দেখা হলে সালাম দিতাম। জবাবে তিনিও কুশল বিনিময় করতেন। একদিন মৃদু হেসে বললেন, ‘কিতাবা, হউর বাড়ি যাওনি? তোমার বউতো আমার নাতিন।’ হ্যাঁ, আমার স্ত্রী পক্ষের সাথে স্যারের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। সুবাদে আমি তাঁর নাতিন জামাই। বছর পাঁচেক আগে আমি অপর একজনকে নিয়ে যাচ্ছিলাম বিয়ানীবাজারের মাটিজুরার পূর্বদিকে কোথাও। তিনিও সম্ভবতঃ স্কুল শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। সেদিনও কুশল বিনিময় শেষে, আমার সঙ্গিটির দিকে মুখ টিপে হেসে বললেন, ‌'হে আমার ছাত্রও, আর এখন নাতিন জামাই!' কেবল শিক্ষক নয়, মানুষ হিসাবেও তিনি যে খুব সহজ সরল ছিলেন তাও বলাই বাহুল্য।

সেদিন যখন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আমার কর্মস্থলে প্রবেশ করে ফেসবুকটা খুললাম, স্থম্ভিত হয়ে গেলাম। মোল্লা স্যার নেই! দেখতে কখনোই তাঁকে রোগা বলে মনে হয়নি, অথচ...। কাজ করতে করতে সহকর্মির সাথে স্মৃতিচারণ করলাম। জানাজার যে সময়টা নির্ধরণ হয়েছে আছিরগঞ্জে, তাতে যোগ দেওয়া প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হলো। সন্ধ্যায় যখন বাড়ির পথে রওয়ানা হচ্ছি, তখন খুব বেশি মনে পড়ে গেলো মোল্লা স্যারের শেখানো এক আরবি গল্প। গল্পটি এক চালাক শেয়ালকে নিয়ে। তিনি আমাদের অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন অনেক দিন, অনেক বার। তবু তার অর্থ মনে নেই, তবে আরবি উচ্চারণে কয়েক লাইন এখনো মনে আছে-‘হুকিয়া আন্না মাররা সায়লাবা ফি সাজারাতি...’

সারাটা পথ মনে মনে তাই পড়ছি, পড়ছি আর মনে পড়ছে গত শতকের ৮৭, ৮৮, ৮৯, ৯০, ৯১ আর ৯২ এর দিনগুলো। আমার চোখে ভাসছে প্রিয় আছিরখাল, হাইস্কুল, রাস্তা, মারধোর, হরতাল, আর সোনা সোনা কত প্রিয় মুখ! অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ, সহপাঠি, ছোটবড় ভাইবোন, স্কুল মাঠে খেলাধুলা হইচই আর ইসলাম শিক্ষার ক্লাসে মোল্লা স্যারের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। আমি পড়ছি, হুকিয়া আন্না মাররা সায়লাবা ফি সাজারাতি-অটোরিকশা ছুটছে ঢাকাদক্ষিণের পথে, আর আমার চোখে ভাসছে, আমার শিক্ষক মৌলভী সৈজ্জাদুর রহমানের মুখ আর চলাচল।

আল্লার দরবারে বিনীত প্রার্থনা, স্যারসহ সব মৃতকে ক্ষমা করুন, জান্নাতবাসী করুন।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন