আজ বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ইং

বুক ভরা আশা নিয়ে ঘুমিয়ে থাকো শিশির ভেজা দূর্বাদলে

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৯-১৮ ০১:৫৭:১২

সৈয়দ হক ::
(এক) সময়টা আশির দশকের প্রথমার্ধে। আমি তখন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষার জন্য রেডি হচ্ছি। সপ্তাহে একদিন আম্বরখানা গার্লস কলেজ থেকে দত্ত পাড়া হয়ে আম্বরখানায় এনাম স্যারের কাছে পড়তে যাই। হোটেল পলাশ যেখানে সেখানে এনাম স্যার থাকেন। প্রায়ই সকালে দেখতাম দত্তপারার সামনে একটি ফার্নিচার শপে ভাংচুর। রাস্তায় মানুষ জনরে জিগ্যেস করলে বলতো আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আজিজ সাহেবের দোকান জাসদের ছেলেরা ভাঙ্গছে। কাল কলেজে ’মাইর’ হইছিলো। আমার কাছে শাহ আজিজ সাহেব তখনো অচেনা। রাতে বাবার কাছে শুনলাম তিনি একজন গ্রেট মুক্তিযোদ্ধা। আইয়ুব খানকে প্রকাশ্যে জুতা মেরেছেন। এখন মনে মনে ভাবি বুকের পাঠা কতটুকু বড় হলে এমন কাজ করতে পারে !!

(দুই)
এস এস সি পরীক্ষার পর আমি আর আমার বন্ধু নাদেল ”বাবার খেয়ে বলের মোষ তাড়াই ”! সিলেট অঞ্চলে হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ছবি সংগ্রহে গড়ে তুলি ‘স্ম্বতি ৭১’। আন্দোলন সংগ্রামে আমি আর নাদেলের সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ’পাজর’ রাজনৈতিক ধারার সঙ্গী। আমাদের হাতে টাকা নেই। নাদেল বললো, শাহ আজিজ ভাই আছেন। একদিন নাদেল পরিচয় করিয়ে দিলো। দেখি একটা ফতুয়া পড়ে আছেন। নাইটি ট্রাউজারের মতো কিছু একটা পড়ে আম্বরখানায় এক টঙ্গির নীচে আমাদের সাথে নিয়ে চা খেলেন। তাঁর ভাঙ্গা ছাপাখানায় আমাদের সিলেটের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছাপা হতে থাকে। আমি শাহ আজিজ ভাই , মুক্তিযুদ্ধের ওভারসিজ উপদেষ্টা এডভোকেট আব্দুর রহিম , দেওয়ান ফরীদ গাজী , মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আব্দুল হামিদ প্রমুখের দীর্ঘ সাক্ষাতকার লই। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাগুলোতে তখন ” মুক্তিযুদ্ধ ’ নিষিদ্ধ ছিলো। তারপর হঠাৎ দেখি তিনি আমাদের এই টঙ্গিতে ধরে নিয়ে এসেছেন মুক্তিযুদ্ধের ৫ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর মুতালিব। পুরো দমে কমিনিস্ট। সিরাজ শিকদারের ভক্ত।। শাহ আজিজ ভাইয়ের ভাঙ্গা ছাপাখানায় আমাদের চায়ের আড্ডা আর এইসব দিনরাত্রির ইতিহাস খেলা করলো।

(তিন)
অনেক দিন আজিজ ভাইইয়ের সাথে খবর নেই। একদিন কলেজ থেকে আমার গ্রামের বাড়ী যাচ্ছি। গোয়ালাবাজার তাজপুর খাদিম পুর যে দিকে তাকাই খালি দেখি মানুষের বাড়ীর সামনে ’ঘুড়ি’ লাগানো। ছুটো মোটও অসংখ্য ঘুড়ি পথে মাঠে ঘাটে। এজন্য ” পৌষ সংক্রান্তি “ পথে মাঠে ঘাটে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসা। উপজেলা নির্বাচনে আজিজ ভাই দাঁড়িয়েছেন ’ঘুড়ি’ মার্কা নিয়ে। বাসের জানালায় মুখ বের করে দেখি আজিজ ভাই লুঙ্গী আর স্যান্ডো গ্যাঞ্জি পড়ে বসে আছেন গ্রামের কোন এক চা এর দোকানে। আমাকে নামতে হলো তাঁর ডাকাডাকিতে।
 
(চার)
এরপর অনেকদিন তাঁর খবর নাই। ঢাকায় যখন পড়ি তখন এক ছুটিতে বাড়ী গেলে মা বললেন আজিজ মিয়া রে চিনস। পাগলা বেটা। আমাদের বাসায় মা দরজা খুলতেই নাকি আজিজ ভাই মাকে পা ধরে সালাম করতে ছেয়েছেন। মা নাকি সেসময় দশ হাত পিছনে ’ফাল’ দিয়েছিলেন। একদা নাকি তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমি আর নাদেল নাকি তাঁর দেখভাল করেছি সেই কৃতজ্ঞতা জানাতে। বিকালে সুবিদবাজার পুকুরপারে তাঁর বাসায় গেলে আমাকে বুকে ধরে বললেন , তোমার রেফারেন্সে কাজ হইছে। আমি নমিনেশন পাইছি। তাঁর চোখে জল।

(পাঁচ)
আইয়ুব খানকে জুতা মারার পর পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক তিনি নির্যাতনের স্বীকার হন। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পর এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হন। ইমদাদুল হক মিলনের ‘কালো ঘোড়া , দ্বিতীয় পর্বের শুরু ‘র উপন্যাসের নায়কের মতো একাত্তরে পরম মমতায় লুকিয়ে রাখা বাড়ীর পিছনের ঝাউবন থেকে উঠে আসে চকচক অস্ত্র। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে বেরিয়ে পড়েন বাঘা কাদের সিদ্দিকির সাথে।

(ছয়)
প্রথম আলোর নর্থ আমেরিকা এডিটার ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন ভাই গতকাল লিখেছেন - অঞ্চল কাঁপানো নেতা , জনগণের জন্য নিঃশেষ করে দেওয়া জননেতার শেষ প্রতিচ্ছবি র নাম শাহ আজিজুর রহমান। এই মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রহণ করেছে দেশের মাটি। এই মাটিতে ঘুমিয়ে আছে হাজারো মুক্তিযোদ্ধা। বুক ভরা আশা নিয়ে ঘুমিয়ে আছে তাঁরা। প্রিয় আজিজ ভাইও ঘুমিয়ে থাকুন বুক ভরা আশা নিয়ে , এই শিশির ভেজা দূর্বাদলে। সেলাম।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন