আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বিশ্ব শিক্ষক দিবস এবং বেসরকারি শিক্ষকদের অবস্থা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১০-০৪ ১০:৪৩:৪৬

প্রভাষক মুহাম্মদ আব্দুল মতিন :: ৫ই অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ইউনেস্কো ঘোষিত এই দিবসটি ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্বের ১০০টি দেশে অত্যন্ত মর্যদার সাথে পালিত হয়। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাপরিচালক ফ্রেডেরিকো ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসাবে ঘোষনা করেন।ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়। বিশ্বজুড়ে সরকারি ও বেসরকারী ভাবে বিভিন্ন শিক্ষক ও কর্মচারী সংগঠন এ দিবসটি অত্যন্ত মর্যাদার সহিত পালন করে।

এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (Education International-EI) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০১৮ সালের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- The right ot education means the right to a qualified teacher. শিক্ষার অধিকার মানে দক্ষ শিক্ষকের অধিকার। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অত্যন্ত সময়োপযোগী।

বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করার পূর্বে আসুন দেখে নেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকের অবস্থান। ঞযব এঁধৎফরধহ পত্রিকায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চীনের শিক্ষকরা সেদেশের সকল নাগরিকের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মান পেয়ে থাকেন।চীনে একজন ডাক্তার যে সুবিধা ভোগ করেন, একজন শিক্ষক তার কাছাকাছি সুবিধা ভোগ করেন। পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাস্ট্র, তুরস্ক, গ্রীস, দক্ষিণ কোরিয়া, মিশর প্রভৃতি দেশের শিক্ষকরা সর্বোচ্চ মুল্যায়ন পেয়ে থাকেন।বৃটেনের প্রধান শিক্ষকরা যে মুল্যায়ন পেয়ে থাকেন, পৃথিবীর আর কোথাও তা নেই।চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক এবং মিশরের বাবা-মা’রা তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষক হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশী উৎসাহ দিয়ে থাকেন।

সিঙ্গাপুরের শিক্ষকরা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ বেতন পেয়ে থাকেন। তাদের বেতন গড়পড়তায় ৪৫,৭৫৫ মার্কিন ডলার(বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৩৬ লক্ষ ৬১ হাজার টাকা); মাসিক হিসাবে তিন লক্ষ টাকার চেয়েও বেশি । দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী এবং জাপানে শিক্ষকদের বেতন ৪০,০০০ মার্কিন ডলারের (বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৩২ লক্ষ টাকা) চেয়ে বেশী,যা মাসিক হিসাবে প্রায় ২ লক্ষ ৬৭ হাজার টাকা।আর বৃটেনে শিক্ষকরা পান ৩৩,৩৭৭ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ২৬ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা); মাসিক হিসাবে প্রায় ২ লক্ষ ২৩ হাজার টাকা।

এবার আসা যাক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে।আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলো সরকারিভাবে পরিচালিত হয়।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা উত্তর একটি যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের প্রায় ৩৭ হাজার প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করেছিলেন এবং তার সুযোগ্য উত্তরসূরী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো প্রায় ২৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করেন। পিতা ও কন্যার ঐকান্তিক প্রচেস্টায় আজ দেশের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পুর্ণরুপে সরকারি। একজন প্রাথমিক শিক্ষকের মাসিক গড় বেতন প্রায় ২৫ হাজার টাকা।

পক্ষান্তরে দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবস্থা খুবই করুণ। মাত্র ৩% প্রতিস্ঠান সরকারি আর বাকি ৯৭% প্রতিষ্ঠান বেসরকারি।সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট।সরকারি শিক্ষকরা জাতীয় বেতন স্কেলের মূল বেতনের পাশাপাশি ৫% বার্ষিক প্রবৃদ্ধি,মূল বেতনের ৪৫-৫০% বাড়িভাড়া, ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, মূল বেতনের ১০০% হারে দু’টি উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, শিক্ষা ভাতা, টিফিন ভাতা , বদলি সহ নানাবিধ সুবিধা পেয়ে থাকেন।

পক্ষান্তরে, ৯৮% শিক্ষার ভার যাদের উপর নিপতিত, সেই বেসরকারি শিক্ষকরা উপর্যুক্ত সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত।সবচেয়ে পীড়াদায়ক যে বিষয়টি সেটি হল, এতদিন এমপিওভূক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের সরকার প্রদত্ত বেতনকে ‘বেতনের সরকারি অংশ” হিসেবে আখ্যায়িত করলেও ফরাস উদ্দিন কমিশন প্রণীত বর্তমান পে-কমিশন এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের বেতনকে ‘অনুদান সহায়তা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।দেশের ৯৮% শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে যারা দিবারাত্র মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময় স্বরুপ তাদেরকে অনুদান প্রদান করা- শিক্ষক সমাজের সবচেয়ে বড় অংশের এর চেয়ে বড় অপমান আর কি হতে পারে?

পূর্বে বেসরকারি শিক্ষকদের সারাজীবনে একটি মাত্র ইনক্রিমেন্ট থাকলেও ফরাস উদ্দিন কমিশন সবেধন নিলমণি সেই ইনক্রিমেন্টটি ও বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রিন্সিপাল থেকে দপ্তরী পর্যন্ত সবার বাড়িভাড়া মাত্র ১০০০ টাকা, বর্তমান বাজারে যা দিয়ে একটি কুড়ে ঘরে থাকাও দুস্কর।চিকিৎসা ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা, অথচ একজন ডাক্তারের একবারের ভিজিট ও তার চেয়ে বেশী।মূল বেতনের ২৫% বোনাস, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক যে, একজন শিক্ষককে নিজের ও নিজের পরিবার ও আতœীয় স্বজনের চাওয়া মেটাতে না পেরে তাদের কাছে লজ্জিত হওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকেনা।

পূর্বে একটি মাত্র টাইমস্কেল পেয়ে সারা জীবনে একবার বেতন বৃদ্ধির সুযোগ থাকলেও বর্তমান পে স্কেলে তা বাতিল করা হয়। স্কুল শিক্ষকদের পদোন্নতির কোন সুযোগ নেই।কলেজ শিক্ষকদের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির একটি সুযোগ থাকলেও অনুপাত প্রথা (৫ঃ২)এর কারণে অধিকাংশ প্রভাষককে সারা জীবন একই পদে থেকে অবসরে যেতে হয়। অনুপাত প্রথা অর্থাৎ ৭ জন প্রভাষকের মধ্যে ২ জন প্রভাষকের ভাগ্যে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ ঘটে। অবশিষ্ট ৫ জন ২০১০ এর এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী নবম গ্রেড থেকে ৭ম গ্রেডে উন্নতি হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু ২০১৮ এর এমপিও নীতিমালায় ১০ বছর পর ৮ম গ্রেড এবং ১৬ বছর পর ৭ম গ্রেডের বেতন পাওয়ার বিধান করা হয়েছে। অর্থাৎ ৮ বছর পূর্তিতে যিনি সহকারী অধ্যাপক (৬ষ্ঠ গ্রেড) হতে পারলেন না, তার বেতন ১০ বছর পর মাত্র এক হাজার টাকা বৃদ্ধি পাবে। এর চেয়ে বড় বঞ্চনা আর কি হতে পারে। পাশাপাশি বার্ষিক প্রবৃদ্ধি না থাকায় একজন এমপিওভূক্ত শিক্ষক যে বেতনে যোগদান করেন সে বেতনেই তিনি অবসরে যান।

২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারী জাতীয় প্রেসক্লাবে বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফেরামের টানা ২০ দিন অবস্থান ও আমরণ অনশনের শেষ দিনে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের দুইজন সচিব এসে ৫% ইনক্রিমেন্ট এবং বৈশাখী ভাতার ঘোষণা দেন। এরপর বিভিন্ন সময় শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষক নেতৃবৃন্দকে আশ^াস দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু অদ্যবধি এসব আশ^াসের কোন বাস্তবায়ন ঘটেনি।

সরকারি স্কুল/কলেজে যে সিলেবাস, সেই একই সিলেবাস পড়িয়ে, সমান যোগ্যতা নিয়ে, স্কুল পর্যায়ের একজন শিক্ষকের বেতন ১২,৫০০- ১৬০০০ টাকা আর কলেজ পর্যায়ে একজন প্রভাষক পান ২২০০০ টাকা।অথচ একজন সরকারি অফিসের পিয়নের বেতন ও ২৫০০০ টাকা বা তার চেয়েও বেশি।

আজ দেশ যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে,পদ্মা সেতুর মত দুঃসাহসিক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, ঠিক তেমনি মুহুর্তে জাতির মেরুদন্ড গড়ে দেওয়ার কারিগর শিক্ষকদের এ দুরবস্থার অবসান কল্পে সব অসম্ভব সম্ভবকারী জাতির জনকের কন্যা , মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে কোন প্রকার আয় ছাড়া সম্পুর্ণ সরকারী ব্যায়ে প্রায় ২৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণের মত সাহসী কাজ করেছিলেন, ঠিক তেমনি ভাবে সাহসী নেত্রী কোনরুপ সরকারি ব্যায় ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর তহবিলে থাকা কোটি কোটি টাকা দিয়ে অনায়াসে জাতীয়করণ করতে পরেবেন।বিশ্ব শিক্ষক দিবসে একজন শিক্ষক হিসেবে এটাই আশা করি।

লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী, ফোরাম সিলেট জেলা।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন