আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

'প্রদীপ নিভিয়া গেল'

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১১-০৯ ১১:০২:২৫

আলমগীর হোসেন :: যখন লিখছি তখন না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার তিন দিন হলো। আপনি এভাবেই আড়াল হবেন ভাবিনি কখনও। চায়ের আড্ডায়, সেল্ফি ব্রিজে, কিন ব্রিজের নিচে, কলেজের প্রতিটি কক্ষে, খান মঞ্জিলে আপনাকে খুঁজেছি, পাইনি কোথাও। আবার দেখি, আপনি মিশে আছেন সবখানেই, রাজা হয়ে, আলো ছড়িয়ে। হ্যা, স্যার, মানুষ যে জগতে যায়, সবাই যায়, আপনিও গেলেন, আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু এভাবে আমাদেরকে একা রেখে!

স্যার, মনে পড়ে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত খান মঞ্জিলে আড্ডা আর খাবারের কথা? আপনি মানুষদের খাওয়াতে এত ভালোবাসতেন কেন? জোর করে ধরে নিয়ে, রিকশায় তুলে সরাসরি রেস্টুরেন্টে। আপনি প্রায়ই বলতেন স্যার, জগতের মোহ ছাড়তে হবে। মানুষ শুধু টাকা চায়, বাড়ি চায়, গাড়ি চায়, কী হবে এসব দিয়ে? আপনি শুধু বলতেনই না, তা মানতেনও। এবং তার জন্যেই স্বপ্নের আমেরিকা ছেড়ে দেশে চলে আসলেন, মাটির কাছাকাছি চলে আসলেন, দেশের মাটিতেই ঘুমিয়ে পড়লেন!

স্যার, সেল্ফি ব্রিজের কাহিনি মনে পড়ে? আপনার মনে নাই পড়ুক, আমার বেশ মনে পড়ছে। খালেদ ভাই ( কবি Khaled Ud-deen), বন্ধু জসিম (প্রভাষক Jashim Uddin) আর আমি অপেক্ষায় ছিলাম কাজিরবাজার ব্রিজে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ব্রিজের উপরে পাখির কিচিরমিচির, চিলের ওড়াওড়ি ছিল তখনও। হঠাৎ ব্রিজের দক্ষিণ পাশ দিয়ে একজন লোক হেঁটে হেঁটে আসতে দেখলাম। কাঁধে বেশ বড়ো পুঁটলি। বদরুল স্যারের মতো লাগছে, হ্যা, বদরুল স্যারই। কিন্তু এত বড়ো পুটলি কি! কাছে আসতেই দেখা গেল, ব্যাগে অনেকগুলো কোমল পানীয়জলের বোতল, অনেক কেক আর আছে 'মামার বাড়ি' ( আপনার লেখা ছড়াগ্রন্থ)। সে-সময়ই লক্ষ্য করেছিলাম, আপনি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন, কিন্তু বন্ধুতা আপনাকে ঘরে থাকতে দেয়নি।

স্যার, বারবার বলতে ইচ্ছে হয়, জীবন এত ছোট কেন? এই কলেজে আপনি আমাকে যে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেটা আর কে করবে, স্যার? শুধু আমারই না, নবীন শিক্ষকরা আপনার প্রেমে এতই বিভোর ছিল যে, গভীর রাত পর্যন্ত তাঁরা হাসপাতালের বারান্দায়, নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। একটিবার আপনার দর্শন ছেয়েছিল তাঁরা, আমরা, সবাই। কিন্তু পারিনি স্যার। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেখার সুযোগ দেয়নি আমাদের। হ্যা, দেখেছি আপনাকে, খান মঞ্জিলে; আপনি শুয়ে আছেন খাটের উপরে, লোকজন আসছে, দেখছে, কান্না করছে। এই যে এত এত মানুষের চাপা কান্না দেখেছি, এদের মধ্যে আত্মীয়, অনাত্মীয় আছেন, রিকশাচালক, দিনমজুর আছেন, একটু সময়ের পরিচিত লোকজনও আছেন। কোন যাদুমন্ত্রে আপনি আপন করে নিতেন যে-কাউকে। সবাই কান্না করে স্যার আপনাকে দেখে। আমি ভেবেছি কি জানেন স্যার, সবাই যখন কাঁদছে, তাহলে নিশ্চয়ই আপনি হাসছেন। আপনার হাসিমুখ বারবার দেখতে ইচ্ছে করে স্যার। আপনার স্নেহের ছায়াতলে আবার আশ্রয় নিতে চাই।

স্যার, আপনি জীববিদ্যার শিক্ষক। কিন্তু আমাদের বাংলা বিভাগে এত বেশি আসা-যাওয়া করতেন সবাই বলতেন, বদরুল স্যারকে বাংলা বিভাগের সংযুক্ত শিক্ষক হিসেবে দেওয়া হলো। আপনি প্রায়ই বাংলা বিভাগে গিয়ে বলতেন, 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।' মনে পড়ে স্যার, একদিন বাংলা বিভাগে চা-পানের সময় কাপ-সংকট দেখা দিল। পরদিন আপনি ছয়টা কাপ-পিরিচ নিয়ে বিভাগে হাজির। আমাদের বিভাগে বসে, ক্যান্টিন থেকে নাস্তা আনিয়ে কোনওদিন আপনি আমাদের বিল দিতে দেন নি।

আপনাকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এত ভালোবাসেন, এত আপন হয়েছেন, এবং আপন করে নিয়েছেনও। মনে পড়ে, আপনি আমেরিকা যাওয়ার উদ্দেশ্যে যখন বিদায় নিতে কলেজে আসলেন, সেদিন মেয়েদের কান্না দেখে থমকে গিয়েছিলাম, অভিভূত হয়েছিলাম, মুগ্ধ হয়েছিলাম। এটাই শিক্ষকপ্রীতি, শিক্ষকপ্রেম, শিক্ষকদের পাওনা। আপনি নিজেও হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। কথা দিয়েছিলেন, আপনি আসবেন, ঠিকই সেই দেশ থেকে চার মাসের মধ্যেই চলে আসলেন।

স্যার, একদিনের কথা মনে পড়লে একা একা হাসতে ইচ্ছে করে, খুব হাসি। কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। মুঠোফোন নেওয়া নিষেধ। পরীক্ষার পর রিকশায় তুলে নিয়ে গেলেন পানসী রেস্টুরেন্টে। চিতল মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার, মাছের বড়ো অংশটুকু আমাকে দিলেন, আপনার অংশের সামান্য খেয়ে আমাকেই দিলেন, জোয়ান মানুষ, বেশি বেশি খাও। ওদিকে মুঠোফোন কিন্তু বাসায়, আমার-আপনারও। বললাম, আম্মা বলছেন, গ্রামে যাওয়ার সময় বড়ো ইলিশ মাছ নিয়ে যেতে। শুনেই আপনি বললেন, চলেন কাজিরবাজার মাছের আড়তে। তারপর লাল বাজার। ওদিকে ঘড়িতে চারটা বাজে। পরীক্ষা শেষ হলো একটায়। অন্যদিন, এই সময়ে গ্রামের বাড়িতে অনেকবার কথা হয়ে যায়। আজ কিন্তু হয়নি। বাড়ির সবাই চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। ওইদিন বাসায় ছিল আমার বন্ধু শিব্বির। সে ফোন ধরে সবার। শুধু এটুকু বলে, আলমগীর তো পরীক্ষার ডিউটিতে গেল। আসবে, হয়ত কোনও কাজে আটকা পড়েছে। যদিও সে বলে, ভেতরে ভেতরে সেও চিন্তিত। আমরা কফি খেলাম কাজিরবাজার ব্রিজের মুখেই একটা দোকানে। অতঃপর বিদায় নিলাম।

ওদিকে শিব্বির আজির স্যার (বিভাগীয় প্রধান, বাংলা)কে, রুহুল ভাই (পিএ টু ডিরেক্টর, ওসমানী মেডিকেল)কে ফোন করে বলে আমি বাসায় ফিরিনি। সোহেল স্যার (বিভাগীয় প্রধান, ব্যবস্থাপনা) কে আজির স্যার ফোন করেন। বিরাট হইচই পড়ে যায় আমাকে নিয়ে। আপনাকেও অনেকে ফোন করে, কিন্তু আপনাকেও পায়নি কেউ। ওদিকে বাড়িতে ঘটেছে আরেক কান্ড। ফোনের কথাবার্তা বুঝে, পিচ্ছি এক ভাতিজা সিজান আমার কন্যা নামিরাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলছে, তোর বাবায় একসিডেন্ট করছইন গো। শুনে ফেলেন আমার আম্মা। এই যে শুরু হয়ে গেল আমার মায়ের কান্না। পরদিন আপনাকে বলার পর আপনি বললেন, এভাবে মাঝেমাঝে ডুব দেওয়া ভালো। কিন্তু স্যার, আপনি যে চিরতরে ডুব দিবেন সেটা কে জানতো?

এমসি কলেজ এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সোনালি বিকেলের কথা মনে পড়ে স্যার। সেইদিন হাঁটা, ছবি তোলা, অনেক উঁচুতে শহিদ মিনারে উঠে দেশের গান করা, সব মনে পড়ে স্যার। অচেনা, অজানা চারটা ছেলেকে ওইদিন কয়েক মিনিটের মধ্যেই আপনার প্রেমে ফেলে দিলেন। তাঁরা গান করে, আমাদের অনেকগুলো গান শুনিয়েছিল তাঁরা। একদিনও আপনার মলিন মুখ দেখিনি, কারও সাথে রাগ করতে দেখিনি, উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনিনি। এই শিক্ষাই দিতেন আপনি আমাদের।

স্যার, বিজয়ফুল উৎসবের কথা মনে পড়ে। আপনি প্রধান সমন্বয়কারী, আমরা আরও দুইজন ছিলাম আপনার সহযোদ্ধা। আপনি শাপলা ফুল বানাতে পারেন, গান করতে পারেন, আবৃত্তি পারেন। সেইদিন সুন্দর শাপলাটা বাংলা বিভাগকে উপহার দিয়েছিলেন, আপনাকে কিছুই উপহার দেওয়া গেল না। আপনি ওইসময় অসুস্থ থাকায় প্রতিযোগিতায় যাওয়া হয়নি আমাদের।

স্যার, আপনার শেষ কর্মদিবসের স্মৃতি, কথা ঝলঝল করে উঠছে। আপনি মৃত্যু প্রসঙ্গে বলেছিলেছিলেন, কলেজের কোনও শিক্ষক-ছাত্রী মারা গেলে গেইটে ব্যানারে লেখা হবে, অমুক মেধাবী শিক্ষকের মৃত্যু, কিংবা অমুক মেধাবী ছাত্রীর মৃত্যু। এ কী হলো! আপনার কথা ফলে গেল আপনার উপরেই! এর সপ্তাহখানের মধ্যেই আপনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে!

কলেজের গেইটে ব্যানার ঠিকই লাগিয়েছি স্যার, শোকসভা, দোয়া মাহফিল করেছি আমরা। আপনি যে নাই কোথাও! তাহলে প্রদীপ হাতে আলো জ্বালাবে কে? আরও কিছুটা দিন পারতেন না স্যার, আলো হাতে দাঁড়াতে? রাজা হয়ে আলোকের মাঝখানে বসতে? আর, আমরা পেতাম আপনার স্নেহের পরশ। এভাবেই অসময়ে প্রদীপ নিভিয়া যাইবে- কে জানিত হায়!

লেখক ::
প্রভাষক, বাংলা বিভাগ
মইনউদ্দিন আদর্শ মহিলা কলেজ, সিলেট।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/০৯ নভেম্বর ২০১৮/ এএইচ/ আআ

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন