আজ বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪ ইং

ক্লাস নাইনের আমি এবং অরিত্রী

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১২-০৭ ০০:৪৩:৩৫

জয়নাল আবেদীন :: ২০০৬ সাল, আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। সপ্তম শ্রেণী থেকে ক্রিকেট খেলাটা ধ্যান জ্ঞান হয়ে যায়। সারাদিন ক্রিকেট খেলা, আড্ডা আর ভিসিডি প্লেয়ারে মুভি দেখে কাটাতে লাগলাম। এসব করতে করতে ৭ম, ৮ম দুই শ্রেণীতে রেজাল্ট খারাপ হল। কোনরকমে স্যারদের দয়ায় পরের ক্লাসে পড়ার সুযোগ পাই। নাইনে ওঠার পর আমার স্কুল তৎকালীন রাইফেলস পাবলিক স্কুল, সিলেট নিয়ম করে বসলো এক বিষয়ে ফেল করলে এবার আর পাশ করিয়ে দিবেনা। কে শুনে কার কথা। টেপ টেনিস বল ছেড়ে তখন ব্যাট প্যাড নিয়ে খুব স্কুল ক্রিকেট আর লোকাল একটি ক্লাবে খেলা শুরু করি।

নিজের চিত্তবিনোদন ভালই হচ্ছিল শুধু পড়াটাই হচ্ছিলনা। মা, বাবা এবং বাসার শিক্ষক সবাই খুব চেষ্টা করছে।বাট কাজ আর হয়না। পড়তে আমার মন বসেনা। যাইহোক ক্লাস নাইনে ফাইনাল পরিক্ষা দিলাম। রেজাল্টের দিন আর স্কুলে যাইনি কারন আমি জানতাম ভাল কিছু আসবেনা। দুইদিন পর রেজাল্ট আনতে গিয়ে দেখি অংকে ফেইল। এবার আর উত্তীর্ণ করে দিবেনা সো ফেইল। ডাক পড়লো অভিভাবকের। আব্বাকে নিয়ে গেলাম। হেড স্যার প্রয়াত আজহার আলী স্যারের রুমে। স্যার খুব সুন্দর করে বুঝালেন, আমার সমস্যার বিষয়গুলো জানতে চাইলেন। ইংলিশ আর অংক এই দুইটাতে সমস্যা। স্যার স্কুলের একজন স্বনামধন্য ইংরেজি শিক্ষককে ডেকে আনলেন। বল্লেন আমাকে যেন একটু পড়ান আর আব্বাকে বল্লেন স্যারের সাথে কথা বলতে।

হেড স্যার চলে গেলেন। ইংরেজি শিক্ষক (নামটা মেনশন করতে চাইনা) রেজাল্ট কার্ড হাতে নিলেন, দেখলেন এবং এরপর ইচ্ছেমত কথা শুনালেন আমাকে আর আব্বাকে। সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল স্যার আব্বাকে বল্লেন দেখেন আমি যে ব্যাচগুলো পড়াই ওখানে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছেলে মেয়েগুলো পড়ে। ওরা সপ্তাহে ৫টা প্যারাগ্রাফ মুখস্ত করে। আপনার ছেলেতো একটাও পারবেনা। আমি আমার সুনাম নষ্ট করতে পারবনা। স্যারের এত অহংকারী কথা শুনে খুব কষ্ট পেলাম সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেলাম যখন আমার আব্বা মাথাটা নিচু করে ছিলেন। এরপর আব্বাকে বল্লাম ওঠে যেতে। বাসায় চলে আসলাম। আব্বাও কিছু কথা শুনালো। যাইহোক কষ্ট লজ্জা রেখে আবার নাইনে ভর্তি হলাম। আর মনে মনে একটা জেদ করলাম, যেভাবেই হোক অন্তত ৪০-৪৫ টা প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করতেই হবে। সেই সাথে হতে হবে ক্লাসে প্রথম। পড়া শুরু করলাম দিন রাত।

আমাদের স্কুলে ছিল সেমিস্টার সিস্টেম। যাইহোক প্রথম সেমিস্টার পরিক্ষাটা দিলাম। এর আগে অনেক ঘটনাই ঘটতে থাকলো আমার সাথে। শিক্ষকরা পড়া জিজ্ঞেস করলে সবার আগে হাত তুলতাম। প্রতিত্তোরে শুনতে হত এই তুই বস, তুইতো ফেল করা, তুই পড়ছিস! এমন কিছু শব্দ। যা আমার জেদ আরও বাড়িয়ে দিল। সকাল সকাল স্কুলে গেলাম। আজ রেজাল্ট দিবে। আমাদের তিনটা সেকশন ছিল এ, বি, আর সি। আমি গাধা ছাত্র সো সি সেকশনেই রোল। যাইহোক সাইন্স, কমার্স সবার রেজাল্ট ঘোষনা হয় আমার আর্টসের রেজাল্ট আর বলা হয়না। এর মাঝে ক্লাস টিচার নিখিল স্যার বলতেছিলেন চমক আছে এবার। মনের মাঝে ভয়। এ বি সেকশন শেষ করে হেড স্যার সহ অন্য শিক্ষকরা আসলেন আমাদের সেকশনে আর্টস আর কমার্সের রেজাল্ট জানাবেন মানে যারা যারা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছে তাদের নাম ঘোষণা করবেন হেড স্যার।

কমার্সের রেজাল্ট দিল সুব্রত, অঞ্জন আর বিশ্বজিত প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় হল। এখন মানবিকেরটা দেয়ার পালা। তৃতীয় কে হয়েছিল মনে নেই দ্বিতীয় হয়েছিল বি সেকশনের একটা মেয়ে। এখন প্রথম ঘোষণা করবে এটা যে কে হল সেটাই চমক। আমরা ওয়েট করতেছি এরপর স্যার ঘোষনা করলেন আমার নাম। যখনই নামটা শুনলাম চোখে পানি চলে আসলো। সবাই অভিনন্দন জানালো। কয়দিন পর এই ক্লাসেই ক্যাপ্টেন হলাম। এসএসসিতে ভাল রেজাল্ট করলাম। এইচএসসি ভাল করে আজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনও শেষ করলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে ভাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

এতকিছু লিখার একটাই কারন অরিত্রী। যে মেয়েটা ক্লাস নাইনে আত্মহত্যা করলো। আমি আরও যারা অরিত্রীর মত আছো আমার ছোট ভাই, বোন তাদের বলতে চাই। যদি এমনটা তোমার সাথেও হয়ে থাকে তাহলে নিজেকে শুধরাও, মনের মধ্যে জেদ নিয়ে আসো ভাল করার। দেখবা ক্লাসের ফেল করা ছাত্রটাই কিভাবে প্রথম হয়। এই যে আমিই এর উদাহরণ। সো প্লিজ আত্মহত্যা করার চিন্তা করনা চিন্তা কর নিজেকে নিয়ে। আজ তুমি আত্মহত্যা না করে যদি সহ্য করতে, আমার মত জেদ করতে তাহলে দেখতে চ্যালেন্জ নিয়ে তুমি তোমার অপমানের বদলা নিতে। সেটা কাউকে কষ্ট না দিয়েই।

আর হ্যা ঐ যে আমার ইংরেজি শিক্ষক উনি নিজেই আমার বাবার কাছে এসেছিলেন, আমি যেন উনার কাছে পড়তে যাই সেজন্যে। আমার শিক্ষকদের প্রতি কোন রাগ ছিলনা কখনই। রাগ করেছিলাম নিজের প্রতি আর স্পৃহা ছিল ভাল কিছু করার। সবচেয়ে ভাল ছাত্রটি হওয়ার। ফেল করা ছাত্র রাইফেলস স্কুলে আর প্রথম হয়েছিল কিনা জানিনা। তবে এরপর থেকে আমি আমার জীবনটা বদলাতে পেরেছিলাম। তাই বর্তমানের সকল অরিত্রিদের বলতে চাই আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়। এই জঘন্য কাজটা করবেননা প্লিজ।তাই একটাই চাওয়া, জেগে ওঠো, সচেতন হও এবং লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত থেমো না।

ভাল থাকুক সকল অরিত্রী, ভাল থাকুক সকল শ্রদ্ধেয় শিক্ষক।

লেখক: সাবেক স্কুল ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
(লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন