আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

রমজান পালন ও চ্যারিটি বন্টন

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২১-০৫-০৬ ১৬:৪৭:৩৮

বাবরুল হোসেন বাবুল ::

বছর ঘুরে আসে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজান। এ মাসটি মুমিন বান্দাদের জন্য প্রত্যাশার, আনন্দের। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মহিমান্বিত রমজান পেয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মশগুল হন ইবাদতে। কারণ রমজানের গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহপাক পবিত্র কুরআন নাযিল করেছেন এই মাসেই। হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম রজনী লাইলাতুল কদর পাওয়া যায় এই রমজানের শেষ দশ দিনের মধ্যেই। সাওম বা রোজা পালনকারীদের ইবাদত-বন্দেগি দ্রুত পৌঁছার জন্য মহান প্রভু রমজান মাসে আকাশের দরজা উন্মুক্ত করে দেন এবং শৃঙ্খলে বন্দী করেন পাপিষ্ট শয়তানদের।

মানুষের কুপ্রবৃত্তি দমন, তাকওয়া অর্জন ও মানবিক গুণাবলী প্রস্ফুটিত করবার জন্য রমজানের রোজা অধিক উপকারী। রোজার গুরুত্ব শারীরিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যায়, উপবাসের ফলে মেধাশক্তি বৃদ্ধি, অতিরিক্ত দৈহিক ওজন হ্রাস পায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও কোষের পুনর্গঠন হয়, উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকার হয়। আবার মানসিক দিক বিবেচনায় রয়েছে ধর্মের প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি, নমনীয়তা, সচেতনতা, প্রশান্তিসহ বেশ কিছু আধ্যাত্মিক উন্নয়ন সাধিত হয়, যা দ্বারা একজন সংযমী ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাসের মাধ্যমে আহার বর্জন, পানাহার, ধুমপান ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত থেকে রোজাদার সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কষ্ট-যাতনা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।

ভোগবিলাস, খানাপিনা, আনন্দ উপভোগ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। রমজান এলে একদিকে যেমন ইবাদত-বন্দেগির মাত্রা বেড়ে যায়, অন্যদিকে খাবার টেবিলে রকমারি ইফতার সামগ্রীর সমাহার না থাকলে অনেকের মনে তৃপ্তি আসে না। উপবাসের পর প্রচুর খাবারদাবার, ভুরিভোজ রোজার মাহাত্ম্যকে বিনষ্ট করে। অনেক পরিবারে মহিলাদের ইফতার ও সেহরির খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত থাকতে হয় সারাদিন। মহিলাদের উপর রান্নাবান্নার অতিরিক্ত চাপ বেড়ে যাওয়ায় তারা রমজানে ইবাদত-বন্দেগী ও বিশ্রাম করার সুযোগ পান কম। সচ্ছল পরিবারগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইফতারের সময় যে খাবার সরবরাহ করা হয় তার বেশ কিছু অংশই অপচয় হয়। আমাদের মহানবী (সা.) দিনভর রোজা শেষে দু-একটি খেজুর ও স্বল্প খাবারের মাধ্যমে ইফতার সম্পন্ন করতেন। কিন্তু আমরা রাসুলের শিক্ষা থেকে সরে এসেছি। আমাদের উপলব্ধি করা জরুরি, রমজানের শিক্ষা হলো সংযম, সংবরণ, সহনশীলতা, আত্মশুদ্ধি ও মানবিক গুণাবলি অর্জন করা।


ধন-দৌলত, প্রাচুর্য-বিত্ত, জৌলুসের মধ্যে বসবাসকারী ও গরীব অসহায় বিত্তহীন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে দেয় রমজান। বিত্তবান রোজাদার উপলব্ধি করতে পারেন বিত্তহীন ক্ষুধাতুর নিরন্নের বেদনা। রমজানে রোজা মানুষের মনে দয়ার উদ্রেক করে, সম্পদশালীদের মনে জাগে উদ্বৃত্ত সম্পদ বন্টনের স্পৃহা। তাই তো দেখা যায়, বছরের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় রমজান মাসে মানুষ দানদক্ষিণায়, খাবার-দাবার বিলিয়ে দিতে বেশি তৎপর। এর উদ্দেশ্য শুধু পুণ্য হাসিল নয়, বরং রমজানের উপবাস থেকে সৃষ্ট অনুভূতি ও মানবিকতা আমাদেরকে চ্যারিটি প্রদানে উদ্বুদ্ধ করে।

রমজানে ধনী মানুষ গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ান সাধ্যমতো। অবস্থাশীলরা এগিয়ে আসেন সহায়সম্বলহীনদের জন্য বিভিন্ন রকম খাবার যেমন- চাল, ডাল, তেল, ময়দা ও কাপড়-চোপড় সামগ্রী নিয়ে। বাংলাদেশে অনেক পারিবারিক সামাজিক ট্রাস্ট ও ব্যক্তি উদ্যোগের মাধ্যমে গরিব লোকদের একত্রিত করে তাদের হাতে বন্টন করা হয় পণ্যসামগ্রী। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে গরিব লোকদের ফটো তোলা হয়, প্রচার করা হয় ফেইসবুক ও পত্রপত্রিকায়। ঈদের সময় শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণকালে সাহায্যপ্রার্থী মানুষের গাদাগাদি, ঠাসাঠাসিতে প্রাণহানির সংবাদও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

দারিদ্রতা মানুষের অপরাধ বা সমাজের জন্য অভিশাপ নয়। সৃষ্টিকর্তা আদম সন্তানদের মর্যাদা ও সম্পদ ভোগে অসমতা বা তারতম্য বেঁধে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। না হয় দুনিয়ার সবকিছুই স্থবির হয়ে পড়তো। দুস্থদের প্রতি সম্পদশালীদের সম্পদ বন্টন ও মানবিক হওয়ার জন্য কুরআন ও হাদিসে বার বার বলা হয়েছে। দারিদ্রতাকে পুঁজি করে আজকাল ব্যক্তি গোষ্ঠী দল ও সংগঠনসমূহ চ্যারিটি সেবার নামে যেভাবে গরিব মিসকিন এতিমদের সমাবেশ ঘটিয়ে দান-দক্ষিণা করছেন, তা রীতিমতো আত্মপ্রচারের নামান্তর। রাজনীতিকরা ‘জনদরদি’ ‘জনসেবক’ ‘গরিবের বন্ধু’ ইত্যাদি নামে দুস্থ অসহায় মানুষদের মিডিয়ার সামনে দান-খয়রাত করে জনগণের বাহবা নেন।

একইভাবে সামাজিক ও পারিবারিক ট্রাস্টসমূহ অতিথিদের সামনে চ্যারিটি বিতরণ করে মানুষের সেবা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এভাবে হতদরিদ্র লোকদেরকে ডেকে এনে যে কোন প্রকার দান-দক্ষিণায় দানগ্রহীতার উপর দাতার কর্তৃত্ব, প্রভাব বা নেতৃত্ব প্রকাশ পায়। অথচ ইসলাম ধর্মে দান-খয়রাত এমনভাবে করতে বলা হয়েছে, যাতে ডান হাতে দান করলে বাম হাত টের না পায়। কিন্তু আজকাল যেভাবে দান-খয়রাত করা হয়, তা পবিত্র কুরআনের ভাষায় রিয়া বা প্রদর্শন বলা হয়।

রিয়া সম্পর্কে সাবধান করে সুরা বাকারাহর ২৬২নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহতালার পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে এবং যা কিছু করে তা প্রচার করে বেড়ায় না, প্রতিদান চেয়ে কাউকে কষ্ট দেয় না, তাদের মালিকের কাছে তাদের জন্য পুরস্কার সংরক্ষিত রয়েছে, শেষ বিচারের দিনে এদের কোন ভয় নেই, তারা সেদিন দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না।’ দান খয়রাত বা চ্যারিটি প্রদান সম্পর্কে সহি বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিস হচ্ছে, আল্লার নবী (সা.) বলেন, ‘একজন ব্যক্তির দান-দক্ষিণা প্রদান করবে গোপনে এমনভাবে যেন তার বাম হাত জানতে না পারে ডানহাত কি পরিমাণ দান করলো।’

অতএব চ্যারিটিমূলক কাজে রিয়া নামক গুণাহ থেকে বাঁচাটা জরুরি। অন্যথায় আমাদের দান-খয়রাতের উপর আল্লাহ প্রদত্ত বরকত কম আসবে। দানগ্রহীতা সমাজের প্রান্তিক মানুষরা চ্যারিটি প্রদান আয়োজনে হাজির হন শুধুমাত্র অভাবের তাড়নায়। চারিটি গ্রহণের উপযুক্ত অনেক লোক আছেন যাদের অনেকের পিতা-মাতা বা পূর্বপুরুষরা সচ্ছল ছিলেন। তারা লজ্জা-শরমে দরিদ্র সমাবেশে আসতে অস্বস্তি বোধ করতে পারেন। চারিটি বিতরণ করতে গিয়ে দুস্থ গ্রহীতাদের সমাজের প্রভাবশালী লোক ও নেতা-নেত্রীদের সামনে আসতে বাধ্য করা গরিবদের উপর এক ধরনের জুলুম অত্যাচার ও অপমান বটে।

চ্যারিটি অথবা দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ থেকে শিক্ষা নেয়া যায়। একথা সর্বজনবিদিত যে, হযরত ওমর (রা.) রাতের অন্ধকারে খাবার নিয়ে গ্রামে গ্রামে বস্তিতে বস্তিতে ক্ষুধার্ত জনসাধারণের তালাশ করতেন, ঘরে ঘরে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতেন। সহায় সম্বলহীনদের প্রতি যদি ধর্মীয় ও মানবিক বিবেচনায় চ্যারিটি প্রদান করা হয়, সেক্ষেত্রে দরিদ্র নর-নারীদের কারো বাড়ির আঙ্গিনায় বা কোনো সেন্টারে জমায়েত না ঘটিয়ে দাতা তালিকা করে নিজ উদ্যোগে গরিবের ঘরে ঘরে চ্যারিটি পৌঁছাতে পারেন। এটি হবে একটি উত্তম বন্টন ব্যবস্থা। একইসাথে গরীবদের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতিও দেখানো হবে।

এখানে একটা যুক্তি দাঁড় করানো যেতে পারে এই বলে, দান-খয়রাত গোপনে করলে মানুষের মধ্যে দান-খয়রাত বা কমিউনিটি সার্ভিস করবার উৎসাহ কমে যাবে। মসজিদ মাদ্রাসা ও এতিমখানার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয় প্রকাশ্যে। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কিংবা একজন আরেকজনকে অনুসরণ করে দান করতে উৎসাহিত হন। উপরোক্ত ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে দান-দক্ষিণার ব্যাপারটি সমর্থন করা যায়। কারণ মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা হলো সামগ্রিক প্রতিষ্ঠান, কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তির সমষ্টি নয়। দরিদ্র লোকদের সমাবেশ করে বিভিন্ন প্রকার উপকরণ বন্টন অসচ্ছল মানুষের প্রতি সচ্ছল মানুষের অহমিকায়ই প্রকাশ পায়।

সিয়াম সাধনার ফলে মুমিনগণ তাকওয়া অর্জনের পাশাপাশি সংযম, সহনশীলতা ও ত্যাগের শিক্ষা গ্রহণ করেন। রোজাদারদের আত্মশুদ্ধি ঘটে পবিত্র রমজানে। রোজাদার অর্জন করেন মানবিক গুণাবলী ও উন্নত চরিত্র। অতএব, সিয়াম সাধনা সার্থক তখনি হবে যখন রমজানের ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা গড়তে পারব একটি ন্যায়ভিত্তিক, শোষণমুক্ত, সুষম সমাজ ব্যবস্থা যেখানে প্রবলের দম্ভ অত্যাচার যেন পতিত না হয় দুর্বলের উপর; ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে যেন পরমত সহিষ্ণুতার বিকাশ পায়, সমালোচনার জবাব যেন সংশোধনের মাধ্যমে হয়; ক্রোধ ও প্রতিহিংসার মাধ্যমে নয়।

*লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী।
সাবেক প্রভাষক, বিশ্বনাথ সরকারি কলেজ।
আহবায়ক, ফরোয়ার্ড বিশ্বনাথ।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন