আজ শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪ ইং
জাহাঙ্গীর নোমান :: সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ছাতক উপজেলাকে ভেঙ্গে ছাতক ও দক্ষিণ ছাতক উপজেলা আলাদা করে দু'টি উপজেলায় রূপান্তরিত করার জন্যে জেলা প্রশাসন বরাবর এক চিঠি ইস্যু হয়েছে। এটা নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করার নিমিত্তে এই আলোচনার সূত্রপাত।
তার আগে সংক্ষিপ্ত পরিসরে ছাতকের ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক।
ছাতক বাংলাদেশের সুপরিচিত এক ব্যবসাকেন্দ্র। নদী বন্দর ছাতকে ১৭৭৪ সালে জর্জ ইংলিশ চুনাপাথরের ব্যবসা শুরু করেন। এছাড়া কমলালেবুর জন্যেও ছাতক বিখ্যাত ছিল। ১৯০৮ সালে ছাতকে প্রথম থানা স্থাপন করা হয়। সেই থানা এলাকার আয়তন ছিল প্রায় ৮০০ বর্গ কিলোমিটার যা বাংলাদেশের অনেক জেলার আয়তনের চেয়েও বেশি।
চল ঘোড়া নাদামপুর, ছাতক বাজার কতদূর? আদিকাল থেকে ছাতক বাজারে সপ্তাহে একদিন হাট বসত। হাটে আসা স্থানীয় ও খাসিয়া পাহাড় থেকে আসা বিক্রেতারা রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বাঁশ, বেত ও পাত্তি দিয়ে ছাউনী দেওয়া বেশ বড় আকারের ছাতা ব্যবহার করে তাদের দোকান বসাতো। তখন সারা বাজার ছাতায় ছাতায় ছেয়ে যেত, ছাতা টাঙ্গিয়ে বাজার বসত বলে একে ছাত্তির বাজার বা ছাতার বাজার নামে অভিহিত করা হত। এক পর্যায়ে ইংলিশ কোম্পানি উচ্চারণের সুবিধার্থে ছাতক বাজার নামকরণ করে।
১৯৭৬ সালে ছাতক থানাকে ভেঙে দোয়ারা বাজার থানা ও কোম্পানিগঞ্জ থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপরও আয়তনে বৃহৎ এই থানায় পৌঁছে কাজ সেরে বাড়ি যেতে থানার শেষপ্রান্তের মানুষকে একদিন হাতে নিয়ে বের হতে হতো। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে সেই দূরত্ব কমে আসলেও প্রশাসনের পক্ষে এতবড় থানা সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে জাউয়াবাজার আর জাহিদপুরে দুইটি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ১৯৮৪ সালে ছাতক থানা উপজেলায় উন্নীত হয়। তখন জাউয়াবাজার আর দক্ষিণ ছাতকে পৃথক উপজেলা স্থাপনের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। নানা সময় তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। অবশেষে এ বছর দক্ষিণ ছাতকের দাবির প্রতি প্রশাসন সাড়া দিয়েছে। এটা নিয়ে আবার জাউয়াবাজার উপজেলার দাবিতে সোচ্চার লোকজনের মন খারাপ।
দক্ষিণ ছাতকের পাশাপাশি জাউয়াবাজার উপজেলা হোক এটা আমরা চাই। যতবেশি উপজেলা হবে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ততবেশি হবে। উন্নয়ন বরাদ্দও ততবেশি আসবে। মাঠ প্রশাসন ততবেশি জনগণকে সেবা দিতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে সরকারের সক্ষমতার দিকটিও বিবেচনা করতে হবে। সরকার (NICAR) যদি ভৌগোলিক বাস্তবতায় ছাতকের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি উপজেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে সেটি বাস্তবায়ন করেই ছাড়বে। এক্ষেত্রে সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলা আন্দোলন স্মরণ করা যেতে পারে। তারা দীর্ঘদিন ধরে ধর্মপাশা উপজেলাকে ভেঙে মধ্যনগরকে উপজেলায় উন্নীত করার দাবি জানালেও সরকার কেবল থানা স্থাপন করেছে। কিন্তু মধ্যনগরের পরে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা হয়ে গেছে।
ছাতকের ১৩টি ইউনিয়নের দক্ষিণ ও পশ্চিমে মোট ৭টি ইউনিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে দোলারবাজার, জাউয়াবাজার ও ভাতগাঁও ইউনিয়ন আয়তনে অনেক বড়। সরকার চাইলেই এ তিনটি ইউনিয়নকে ভেঙে ছয়টি ইউনিয়নে রূপান্তরিত করতে পারে। অর্থাৎ ৭টি ইউনিয়ন তখন ১০টি ইউনিয়নে পরিণত হবে। ৫টি ইউনিয়ন দক্ষিণ ছাতকে আর ৫টি ইউনিয়ন জাউয়াবাজারে দিয়ে দুইটি উপজেলা বানানো সম্ভব। তবে সরকার যদি ছাতকের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি মাত্র উপজেলা করার পরিকল্পনা করে থাকে সেক্ষেত্রে বিকল্প উপায় হলো জাউয়াবাজারকে অন্তর্ভুক্ত করে গোবিন্দগঞ্জ-সৈয়দের গাঁওকে ছাতকে রেখে (কারণ ছাতক উপজেলার রাজস্বের স্বার্থে ও দূরত্ব বিবেচনায় গোবিন্দগঞ্জ বাজারকে ছাতকেই অন্তর্ভুক্ত করবে) দক্ষিণ ছাতক কিংবা জাউয়াবাজার উপজেলা নাম না দিয়ে ৫নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ও মুজিবনগর সরকারের এমএনএ আব্দুল হকের নামানুসারে "হকনগর উপজেলা" প্রতিষ্ঠা করা যেভাবে সিলেটের বালাগঞ্জকে ভেঙে মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি এমএজি ওসমানীর নামানুসারে "ওসমানীনগর উপজেলা" করা হয়েছে।।
এতে দক্ষিণ ছাতক ও জাউয়াবাজার উপজেলা উভয়ের জন্যেই উইন উইন পরিস্থিতি বিরাজমান থাকবে। আর উপজেলা সদর সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের পাশে স্থাপন করা যাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা উভয়ের জন্যে সহজ হয় (ইতিপূর্বে সিলেট বিভাগের দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, ওসমানীনগর ও শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা সদর মহাসড়কের পাশে স্থাপিত হয়েছে)। এক্ষেত্রে দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের জাতুয়া পরগণাকে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। যাহোক, উন্নয়ন বঞ্চিত ছাতকের দক্ষিণ-পশ্চিমে এক বা একাধিক উপজেলা স্থাপনে সরকারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
জয় বাংলা।
লেখক: জাহাঙ্গীর নোমান, রাজনীতি ও ইতিহাস বিশ্লেষক।