আজ শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪ ইং
শহীদনূর আহমেদ :: সচিবালয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চোরির অভিযোগে অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনে প্রথম আলো‘র জৈষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে জেল হাজতে পাঠিয়েছে আদালত। এর আগে সচিবালয়ে ৫ ঘন্টা আটকে রেখে শারিরীকভাবে হেনস্থা করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সাংবাদিক রোজিনাকে হেনস্থার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেখানে দেখা যায়, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নাহার গলা টিপে ধরে রাখেন। সচিবায়লয়ে একজন সিনিয়র সচিবের এমন উদ্ধত আচরণ চরম লজ্জার ও দেশের গণমাধ্যমের জন্য হুমকি স্বরুপ।
সচিবালয়ের ইতিহাসে এমন কাজ ন্যাক্কারজনক। পেশাগত দায়িত্ব পালনে সচিবালয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম। এই অতিরিক্ত সচিব রোজিনা ইসলামের গলা টিপে ধরেননি। তিনি ঠোঁটোনি টিপে ধরেছেন দেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার। রোজিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে সরকারি তথ্য চুরির।
হ্যাঁ সাংবাদিক তথ্য চোর! তথ্য চুরি করে সত্য প্রকাশ করে তথ্য চোর সাংবাদিক। এই তথ্য চোরদের কারনেই দেশের অনিয়ম দুর্নীতির কথা জানেন দেশের মানুষ। না হলে হয়তো করোনাকালে সাহেদ-সাবরিনার নির্মিত টেস্ট বাণিজ্যের করোনার করুণ ছায়াছবি দেখতো বাঙালী। এই তথ্য চোরদের কারণেই জাতি দেখেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের ড্রাইভার মালেক কিভাবে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারদের খাবার ও হোটেল বিলে পাহাড় সমান টাকার খবর প্রকাশ করেছিল তথ্য চোর সাংবাদিক। এই তথ্য চোর সাংবাদিকের কারণেই বেরিয়ে এসেছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রকল্পে বালিশ কান্ড। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পর্দা কান্ডের অভিনব দুর্নীতি বের হয়ে এসেছিল এই তথ্য চোরদের কারনেই। এই দুর্ধর্ষ তথ্য চোরদের কারনেই রডের বদলের বাঁশ ব্যবহারের আবিস্কারকদের দেখতে পারে জাতি। তাই গর্ব করে বলতে ইচ্ছে করে আমরা সাংবাদিকরা তথ্য চোর।
তথ্য চুরি করে দুর্নীতি অনিয়মের চিত্র তুলে ধরি। তথ্য গোপন করে টাকার বস্তা পকেটস্থ করি না।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়। সংবিধানে ৭ নং এর (ক) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস ও প্রজাতন্ত্রের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছে।
সংবিধার অনুযায়ি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা রাষ্ট্রের মালিক অর্থাৎ জনগণের আজ্ঞাবহ। নাগরিকের সেবা প্রদান ও রাষ্ট্রীয় কর্ম সম্পাদানই তাদের মূলমন্ত্র। সংবিধানের তৃতীয়ভাগের ৩৯ এর (খ) অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। একই অনুচ্ছেদে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ করতে পারবে। সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে তাঁর কর্ম সম্পাদন করবে। একজন সাংবাদিক কিভাবে তাঁর কর্ম সম্পাদন করেন।
তথ্য, প্রমাণ, সত্য ও বস্তুনিষ্ঠতার মাধ্যমে একজন সাংবাদিক তাঁর সংবাদ প্রকাশ করে থাকেন। একই সংবাদের মূল উৎস হচ্ছে তথ্য। তথ্য ছাড়া কোনো সংবাদ হতে পারে না। সে যে সংবাদই হোক। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ট তথ্য আবশ্যক। সাংবাদিকরা তাদের সোর্স এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন। যা গণমাধ্যম জগতের আদিকাল থেকে চলে আসছে।
২০০৯ সালে সরকার তথ্য অধিকার নামে একটি আইন পাস। তথ্য নাগরিকের অধিকার। দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার জনগণকে উপহার দেয় তথ্য অধিকারের মতো একটি শক্তিশালী আইন।
এই আইনে বলা হয়, সরকারের সুনির্দিষ্ট কিছু দপ্তর বা সংস্থা ব্যতিত বিধিমালা সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নাগরিককে তথ্য প্রদানে বাধ্য থাকিবে। তথ্য যদি অধিকার হয় তাহলে তথ্য চাইতে বা তথ্য নিতে গিয়ে এতো ভোগান্তি কেন। সরকারের আমলাতন্ত্র এই আইন কতটুকু মান্য করেন। চাহিবা মাত্র কি জনগণ তথ্য পেয়ে থাকেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেছি সরকারের যেকোনো দপ্তরের কর্মকর্তা কর্মাচারীগণ তথ্য প্রদানে অনীহা প্রকাশ করেন। যা সত্যিই দুঃখজনক। তাই সত্য প্রকাশে আমাদের নির্ভর করতে হয় নির্ভরশীল সোর্স এর উপর। তথ্য ও সত্য প্রকাশে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরলে আমলাতন্ত্রের দাম্বিকতার রোষানালয়ে পড়তে হয় কর্মরত সাংবাদিকদের। ফলে সাংবাদিক নির্যাতন, খুন, গুমের শিকার হতে হয়। সাগর রুনির মতো অবিচারের রাজ্যে স্থান হয় ইতিহাসের পাতায় ।
সাংবাদিকের কলম সত্য বলে, লিখে সত্যের জয়গান। তাই বুঝি রোজিনাদের মতো অগনিত সাংবাদিকের স্থান হয় জেলের অন্ধকার কুঠিরে। প্রথম আলোর জৈষ্ঠ প্রতিবেদক একজন সাহসী সাংবাদিক। যার কলমে উঠে এসেছে করোনাকালে চলা স্বাস্থ্য বিভাগের অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র। একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তিনি তুলে ধরেছেন করোনা ভাইরাস নিয়ে কিভাবে বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন সচিব-উপসচিবরা। যার ফলে সচিবালয়ে তথ্য চুরির নাটক সাজিয়ে হেনস্থা করে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের দর্পনকে শত শত পুলিশ দিয়ে জেলে নেয়া হয়েছে। পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে সাংবাদিক রোজিনার বিস্ময়ের চাহনি প্রশ্ন করছে দেশ তথা বিশ্ব সাংবাদিককে। কি অপরাধ তাঁর, কি অন্যায় তাঁর। আমি রোজিনার বিচার চাই না। বছরের পর বছর রোজিনা পড়ে থাক কারাগারের অন্ধকারে।
তবুও যদি সাংবাদিক সমাজের বোধদয় হয়। সব বিভেদ ভুলে ঐক্যের ডাক আসে। দাসত্ব আর পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে জয়ধ্বনী হয় সত্যের।
লেখক: সাংবাদিক ও নাট্য অভিনেতা