আজ শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ইং

সম্প্রচার মাধ্যম ছবির গল্পের ঐক্যতান

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২১-০৪-০৪ ২১:২০:৫৫

কাইয়ুম উল্লাস :: টিভি চ্যানেলে আপনি নতুন সংবাদকর্মী ? আপনার জন্যই ‘সম্প্রচার সাংবাদিকতা-১ পাঠ ও বাস্তবতা’ বইটি। এটি লিখেছেন যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ রিপোর্টার সুশান্ত সিনহা। লেখক একজন চলচ্চিত্রকারের মতো বইটিতে টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টি নির্মাণ কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছেন। তুলে ধরেছেন নানা অসঙ্গতি অত্যন্ত রসবোধের সঙ্গে।

বইটি যে শুধু টিভি সাংবাদিকরাই পড়বেন, তা কিন্তু নয়; বইটি পড়তে পারেন আর্টফিল্ম বানাতে চান-এমন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতারাও। কেননা, এই বইতে লেখক দর্শকের শোনার চোখ, দেখার চোখকে গুরুত্ব দিয়ে কিভাবে একটি নান্দনিক রিপোর্ট তৈরি করা যায়, তা নিয়ে চমৎকার লিখেছেন। এই পদ্ধেিত চলচ্চিত্রকাররা তাদের দর্শকের কথা মাথায় নিয়ে কাজ করে থাকেন। তাই বইটি পড়ার সময় আমার কাছে মনে হয়েছে লেখক সুশান্ত সিনহা একজন দুর্দান্ত চলচ্চিত্রকারও বটে। যদি তিনি আর্টফিল্মে হাত দেন, সোনার ফসল ফলবে। কারণ, তিনি বোঝেন দর্শককে। নতুন সংবাদকর্মীকেও তার দর্শকের দিকে খেয়াল রেখেই সিনেমার মতোই নির্মাণ করবেন একটি সফল প্রতিবেদন।

‘সম্প্রচার সাংবাদিকতা-১ পাঠ ও বাস্তবতা’ বইটি তাকে এরকম প্রতিবেদন নির্মাণের কৌশল রপ্ত করতে সাহায্য করবে বলে আমার বিশ্বাস। বইটি প্রকাশ করেছে সৃজনশীল প্রকাশন ম্যাজিক লন্ঠন।

বইটি সম্পর্কে আরেক দুর্দান্ত টিভি সাংবাদিক, যুমনা টেলিভিশনের ‘সুন্দরবনের রিপোর্টার’ খ্যাত মহসিনুল হাকিম যথার্থই লিখেছেন,‘ মাঠে কাজ করতে গিয়ে একজন সাংবাদিককে অডিও-ভিজ্যুয়ালী ভাবতে হয়। সেই কাজটা আমরা শিখি অন্যদের দেখে বা নিজেরা কাজ করতে গিয়ে। বিশেষ করে একটি নিউজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই সূত্রে গাঁথার কাজটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বইটি থেকে সাংবাদিকরা সেই এক সূত্রে গাঁথার শিক্ষা নিতে পারবেন।’ দেখুন এখানে সুন্দবনের থ্রিলার রিপোর্টিয়ের স্রষ্ঠাও বলে গেছেন,‘ মাঠে কাজ করতে গিয়ে একজন সাংবাদিককে অডিও-ভিজ্যুয়ালী ভাবতে হয়’। সেই একই কাজও কিন্তু চলচ্চিত্রকারেরাও করেন তাদের ছবি নির্মাণের সময়। তাই বইটি কিনলে শুধু সাংবাদিকেরাই নন, চলচ্চিত্রকারেরাও লাভবান হবেন।

বইটির মুখবন্ধ লিখতে গিয়ে অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন। তিনি বলছেন,‘ ৮০ দশক থেকে প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের প্রসার ঘটেছে। কিন্তু সংখ্যায় বাড়লেও সুদূর প্রসারী লক্ষ্যে বিনিয়োগের অভাবে সংবাদ পরিবেশনায় বৈচিত্র্য বাড়েনি।’ একদম সত্যি বলেছেন তিনি। দেখুন আজও আল জাজিরার মতো বৈচিত্র্যময় একটি টিভি চ্যানেল দেশে গড়ে ওঠেনি। কারণ, ওই সুদূর প্রসারী বিনিয়োগের অভাব। ড. গীতি আরার একটা কথার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। তিনি বলেছেন,‘ মূলত মুদ্রণ মাধ্যম থেকে আসা সাংবাদিকরাই এখন পর্যন্ত টেলিভিশন সাংবাদিকতা জগতে প্রধান ভূমিকায় আছেন’। দেখুন, সাংবাদিকতা বিষয়ের এথিক্স সম্পর্কে মুদ্রণ মাধ্যমের সংবাদকর্মীরা যতটুকু বোঝেন, তা সাংবাদিকতা বিভাগে পাস করে আবৃত্তি শিখে আসা সাংবাদিকরো বোঝেন না। এর কারণ, তাদের সেই চর্চা নেই, যেটা মুদ্রণ সাংবাদিকদের আছে। সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী তো একজন প্রেজেন্টারও, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি ভালো রিপোর্টার নন। রিপোর্টিং পরিকল্পনা ও কলাকৌশল জানার ক্ষেত্রে মুদ্রণ সাংবাদিকরা এগিয়ে। তাই টেলিভিশনে তারাই প্রধান ভূমিকায় আছেন বলে আমি মনে করি।

লেখক প্রসঙ্গতে আসি। আমার কাছে মনে হয়েছে, টেলিভিশন চ্যানেলে সুশান্ত সিনহা একজন পোড় খাওয়া প্রতিবেদক। তিনি নিঃসন্দেহে একজন নান্দনিক জ্ঞানসম্পন্ন রিপোর্টার। কিন্তু তাকে তার সুন্দর চোখে টিভি চ্যানেলের ভিতরের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, তুচ্ছতা-উদাসীনতা সহ্য করতে হচ্ছে। লেখক বলছেন,‘ নতুন-জুনিয়র সংবাদকর্মীরা মতামত গ্রহণ করে না। উল্টো ভুল ধরছি বলে এড়িয়ে চলে। সংবাদ নিয়ে আলোচনা, তথ্য শেয়ার করে সংবাদ উন্নত করার ব্যাপারে উদাসীনতায় মনঃকষ্ট আছে।’ লেখক যেন প্রতিটি সংবাদ মাধ্যমের ভেতরের অবস্থা তুলে ধরেছেন তার এই কথায়। তবে লেখক দারুণ করে একজন নতুন সংবাদকর্মীকে এই বইটিতে বলছেন,‘ ভালো রান্নার জন্য যেমন ভালো বাজার জরুরি, তেমনি বস্তুনিষ্ঠ ভালো প্রতিবেদন তৈরিতে জরুরি প্রতিবেদকের বাড়তি মনোযোগ ও পরিশ্রম।’ এই উপদেশ মেনে চললে যেকোনো নতুন প্রতিবেদক তার রিপোটিংয়ে ভিন্নতা আনতে পারবেন। এই বৈচিত্র্য আনতে লেখক প্রচলিত চিন্তা ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠে, ভিন্ন দৃষ্টিতে ঘটনাকে দেখা; বিশ্লেষণের দক্ষতা অর্জন করার তাগিদ দিচ্ছেন। লেখকের মতে, সাংবাদিকতায় একদিনে ভালো রিপোর্ট হয় না, এটা ধারাবাহিক চেষ্টার ফসল।

লেখক বইটিতে অরণ্য সরকারের একাধিক রিপোর্ট ভুল রিপোর্টের উদাহরণ দিয়ে প্রকৃত শৈলীতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। রিপোর্টার অরণ্য সরকারকে তিনি একেবারে পচিয়ে দিয়েছেন (হাহাহা)। বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, হাতে কলমে শিখিয়ে সংবাদের মান উন্নত করাই লেখকের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই বই পড়লে সংবাদকর্মীরা পঠনপাঠনে আরও সমৃদ্ধ হতে পারবেন। পিটিসিকে লেখক তুলনা করেছেন ২২ সেকেন্ডের একটি ডেজার্টের সঙ্গে। খাওয়ার পর আমরা যেমন মিষ্টি বা ফল খেয়ে পরিপূণর্তা আনি, পিটিসি জিনিশটাও ওই ডেজার্টের মতো। লেখকের অদ্ভুত রসবোধ ! লেখক কেস স্টাডির মাধ্যমে ভুলগুলো ধরিয়ে সংবাদ তৈরির কৌশলের পথ দেখিয়েছেন বইটিতে। লেখক একজন রিপোর্টারের লেখার শৈলীতা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

বইটির একটা চমৎকার অধ্যায় ‘ভিজ্যুয়াল মিডিয়া’। এখানে লেখক বলছেন, ‘ ভিজ্যুয়াল মিডিয়া বা দৃশ্যগত মাধ্যম মানেই কথার সঙ্গে ছবির গল্পের ঐকতান। এখানে কথার চেয়ে ছবি গুরুত্বপূর্ণ। সিক্যুয়েন্সের ধারাবাহিকতা রেখে দর্শককে আকৃষ্ট করতে হবে প্রতিবেদককে। দর্শকের চোখের প্রশান্তি দিয়ে সংবাদে আটকে রাখা যায়।’ ওই যে আমি আগে বলেছিলাম, লেখক সুশান্ত সিনহা একজন চলচ্চিত্রকারও বটে। লেখক একজন ফিল্মমেকারের ভাষায় বইটিতে দর্শকের চোখ-মন নিয়ে মুনশিয়ানা দেখানোর অনেক মূল্যবান কথাই বলেছেন। টেলিভিশন রিপোর্ট হচ্ছে একটি টিমের কাজ। ক্যামেরাম্যান, রিপোর্টার ও এডিটরের অংশগ্রহণে সম্প্রচারযোগ্য সংবাদ তৈরি হয়। একইভাবে দলবল নিয়ে একটা ভালো শিল্পমানসম্পন্ন ছবি নির্মাণ করা হয়। সিনেমায় দলনেতা থাকেন পরিচালক, আর সম্প্রচার সাংবাদিকতায় দলনেতা থাকেন একজন রিপোর্টার।

তাই রিপোর্টার যদি জানতে চান, কীভাবে আন্তরিক সমন্বয়ে তার ভালো কাজটা আদায় করা যায়? দেরি না করে আজই সুশান্তের ‘সম্প্রচার সাংবাদিকতা-১ পাঠ ও বাস্তবতা’বইটি আপনার রিডিংরুমের টেবিলে এনে উল্টেপাল্টে পড়ুন। আর হয়ে যান একজন ভালো রাজমিস্ত্রি ! নির্মাণ করুন, রূপ, রস ও গন্ধে পরিপূর্ণ একটি প্রতিবেদন।

লেখক: প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন