আজ মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ ইং

মনমোহন সে যে পলকে ঝলক দিয়ে যায়

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৯-১০ ২২:২৯:১৯




:: মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন ::


‘আমি কেমন করে পত্র লিখিরে বন্ধু/
গ্রাম পোস্টাফিস নাই জানা/
তোমায় আমি হলেম অচেনা।/
বন্ধুরে.........../
হইতা যদি দেশের দেশি/
শ্রীচরণে হইতাম দাসী গো/
আমি দাসী হইয়া সঙ্গে যাইতাম রে/
শুনতাম না কারও মানা।/
তোমায় আমি......... ’

লালন ফকিরের জন্মের একশত বছর পরে জন্ম সাধক মনমোহনের। হাসন রাজার জীবদ্দশাতেই ধূমকেতুর মত ঝলক দিয়ে ওঠা এক গানের প্রদ্বীপ। সাধকের চির আরাধ্য পথিকৃৎ মহর্ষি মনমোহন দত্ত। মলয়া সঙ্গীতের আশ্চর্য উৎগীরণ সম্ভব হয়েছিলো যার হাতে, একত্রিশ বছর বেঁচে যাওয়া ক্ষণজন্মা সিদ্ধপুরুষ, বাংলা লোক-বাউল সঙ্গীতের জগতে বিপুলপ্লাবী বর্ষণ সমেত হাজির হয়েছিলেন। যার গান শুনতে কবি জসীম উদ্দীন ছুটে গিয়েছিলেন সুদূর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, যার গানে স্বতন্ত্র এক সঙ্গীত ধারার জন্ম হয়েছিলো।

১৮৭৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলার সাতমোড়া গ্রামে জন্ম। পিতা পদ্মনাথ দত্ত পেশায় ছিলেন একজন কবিরাজ। গ্রামের রামজীবন চক্রবর্তীর পাঠশালা থেকে ছাত্রবৃত্তি পাস করে কুমিল্লার মুরাদনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন, যদিও অর্থাভাবে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিন বছর মোক্তারি পড়েন। সেটিও শেষ করতে পারেন নি তিনি।

আঠারো বছর বয়সে মনোমোহন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ গ্রামের সর্বধর্মসমন্বয়বাদী সাধক আনন্দস্বামীর সাহচর্যে থেকে সংসারের প্রতি বিরাগী হয়ে ওঠেন। অতঃপর চট্টগ্রাম মাইজভান্ডারের পীর মাওলানা আহমদউল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। মাইজভান্ডারের পরিবেশ তাঁকে অধ্যাত্মসঙ্গীত রচনায় উদ্বুদ্ধ করে। তিনি এ ধারায় গান রচনা করে সাধু ও সজ্জন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা ৮৫০। ১৯০৯ সালে তিনি পরলোক গমন করেন এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী লাশ না পুড়িয়ে কবর দেওয়া হয়। 

মনমোহনের গানের কথায় সূক্ষ্মরসের বিস্তর দেখা মেলে। তাঁর গানগুলোতে সুরারোপের ক্ষেত্রে রাগাশ্রয় প্রবল। কথা এবং সুরে একটা ওস্তাদী ব্যাপার রয়েছে। অনেকটা কাজি নজরুল ইসলামের মত।

‘ফকিরি কি গাছের গোটা?
ঢেকি যদি স্বর্গে যাইতো বারা বানতো কেডা?’

‘পাগল পাগল সবাই পাগল তবে কেন পাগল খোডা
দিল দরিয়ায় ডুব দিয়া দেখ পাগল বিনে ভালো কেডা’

‘যেদিন আমার ভবলীলা হবে অবসান’

‘মন্দিরে দেবতা নাই অন্তরে খোঁজ তারে’

‘আমি চাই না বেহেশত চাই না দোযখ’

‘শিখাইয়া দে তুই আমারে কেমন করে তোরে ডাকি’

ইত্যাদি গানগুলো বহুল বিশ্রুত।

মনমোহন নিয়মিত কুরআন ও বাইবেল পড়তেন। বেদ-বেদান্তেও তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল। তাঁর গানের একটি উক্তি হলো, ‘কোরান পুরান আদি বাইবেল কি বেদ, সবে ফুঁকারিয়া কয়, তার অবিচ্ছেদ।’

তিনি গুরুর নামে আনন্দাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন; সেখানে প্রতিরাতে জলসা হতো। তাঁর একমাত্র সন্তান সুধীরচন্দ্র দত্ত আশ্রমের সার্বিক তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন।

মনোমোহনের শিষ্যবর্গের মধ্যে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এর জেষ্ঠ্য ভ্রাতা খ্যাতনামা সুরকার আফতাবউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খাঁ, নিশিকান্ত সেন ও লবচন্দ্র পালের নাম উল্লেখযোগ্য। আফতাবউদ্দিন মনোমোহনের গানে সুরারোপ করেন। মনমোহনের 'ম', লবচন্দ্রের 'ল' এবং আফতাবউদ্দিনের 'আ' মিলে এই ধারার সঙ্গীতের নাম হয়েছে 'মলয়া' সঙ্গীত। কেউ কেউ 'আ' অর্থে আনন্দস্বামীর নাম উল্লেখ করেন।

কিন্তু মলয়া শব্দের মূল অর্থ বসন্ত-বাতাসের সাথে সম্পৃক্ত। বসন্ত সমীরণে মন পবিত্র হয়, আত্মা শুদ্ধ হয়, শুষ্ক দেহ সজীব হয়ে ওঠে। মলয়া সঙ্গীতের মলয় প্রবাহেও মন-প্রাণ-আত্মা পরিশুদ্ধি লাভ করে, দেহ-প্রাণে লাগে সজীবতার পরশ। অন্য একটি মতানুসারে, মলয়া বলতে বুঝায় মলয় পর্বত হতে আগত দখিনা বায়ু।

মনমোহন দত্ত সংগীতের মাধ্যমে ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্টায় জীবন উৎসর্গ করেন। তার মতবাদ “দয়াময়” নামে স্বীকৃত। সকল নামের যোগ যে নামেতে সেই নাম “দয়াময়”। বিশ্ব ঐক্যের নাম দয়াময়। বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের নাম দয়াময়, বিশ্ব প্রেমের নাম দয়াময়, বিশ্ব মানবতার নাম দয়াময়।

এই মতবাদের দুইটি প্রসিদ্ধ আশ্রম রয়েছে। কালিকচ্ছ ও সাতমোড়া। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ যে যেই ধর্মই পালন করুক না কেন, সব একই স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। তাই ধর্ম বিভেদ ঘুঁচাতে সর্ব ধর্মকে সমন্বয় করে "জয় দয়াময়" জপ প্রচার করে গেছেন আমৃত্যু। জয় দয়াময় নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা অঞ্চলে আরো কিছু আশ্রম গড়ে উঠেছে। সেসব আশ্রমে প্রতি বৃহষ্পতিবার মলয়া সঙ্গীতের আসর বসে, চলে বাৎসরিক উৎসবও। এসব আশ্রমকে কেন্দ্র করে ভক্তবৃন্দের ঢল নামতে দেখা যায়।

চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারের অনুসারীরা মনমোহনের ভাব সঙ্গীতের দ্বারা বেশ প্রভাবিত। চিশতিয়া তরিকার মাইজভান্ডার এ অঞ্চলে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে ধর্মচর্চায় মনোযোগ সদা অক্ষুণ্ন রেখেছে। খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতিও তাঁর জীবদ্দশায় তেমনটি করে গেছেন। সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের উৎসাহটি মনমোহন হয়তো মাইজভান্ডারের কাছ থেকে পেয়ে থাকতে পারেন। মাইজভান্ডার প্রসঙ্গে আহমদ ছফা বলেছেন, 'অমৃতভান্ড মাইজভান্ডার'।

মনমোহন দত্তের সমকালীন নানা কুসংস্কার, সামাজিক বিভেদ, সাম্প্রদায়িকতাসহ বিভিন্ন কুপ্রথার বিরুদ্ধে গানের মাধ্যমে প্রতিবাদ তুলে ধরেন। তাঁর গানে স্রষ্টা ও সৃষ্টির অলৌকিক সর্ম্পকও খুব সাবলীলভাবে ফুটে উঠে। এখানেই আমরা খুঁজে পাই বাংলার বাউল মতবাদের চিরাচরিত রূপ। বৌদ্ধ-সহজিয়া, বৈষ্ণব ও সুফীবাদের সম্মিলনে বাংলায় যে বাউল-আধ্যাত্মিকতার উর্বর চাষাবাদ, মনমোহনের গানের মধ্য দিয়ে আমরা সেই ধারার সাথেই একাত্ম হয়ে যাই।

বাংলা লোকগানের বিশিষ্ট এই দিকপাল সুরে ও বাক্যে শ্রোতার মনকে শীতল অনুভবে শান্তির পরম-ভাবে উত্তীর্ণ করার জন্য সুগভীর রস-ভান্ডার দান করে গেছেন। এই গানগুলো নিয়ে ব্যাপক আকারে গবেষণা হবার প্রয়োজন রয়েছে। সুরের উপর আধুনিক কারুকাজ ঢেলে সর্বজন হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপনের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারনে লোকগানের সমৃদ্ধ এই ভান্ডার অনেকটা অযত্নেই পড়ে রয়েছে।


শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন