আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

গল্প: আজ মল্লিকার বাগদান

।। পার্থ তালুকদার ।।

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৭-২৬ ২২:১৬:৫৪

সকাল থেকেই শহর জুড়ে ঝিরঝির বাতাস বইছে। ফাল্গুন মাস। শীতের বুড়ি পুরোপুরি শহর ছেড়ে চলে গেলেও সকাল বেলায় তার অস্তিত্ব কিছুটা আঁচ করা যায়। মল্লিকার কাছে আজকের সকালটা একটু অন্যরকমই মনে হচ্ছে। সেই অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার সময় খুব ভোরে সে ঘুম থেকে উঠে ছাদে গিয়ে পায়চারি করতো। রাত জাগার ক্লান্তি যেন তখন এক নিমিষেই উড়াল দিতো ভোরের চকচকে নীল আকাশের বুকে। যাদুর মতো এই টনিকের ব্যাপারটা সে পেয়েছে তার দাদুর কাছ থেকে। সত্তোর্র্ধ্ব দাদু আজো কীভাবে ভোরের এই রুটিনটা মেনে চলছেন তা তার মাথায় আসে না। আজ অনেকদিন পর ভোরের স্নিগ্ধকর বাতাস গায়ে মাখার জন্য ছাদে উঠলো মল্লিকা। একা একা পায়চারি করছে সে। জীবনের ফেলে আসা স্মৃতিগুলো একে একে ভীড় করছে মনের গহীনে। এ বাড়িতেই তার বেড়ে উঠা। এই বাড়িতেই তার বাবাকে হারিয়েছে। কতশত স্মৃতি। দুঃখের, কষ্টের আবার আনন্দের। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কিছু দিনের মধ্যেই বাড়িটা ছেড়ে চলে যেতে হবে তার। বসতি গড়বে নতুন ঠিকানায়।

সকাল দশটা। ছোট বাসাটায় মানুষ গিজগিজ করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লিটনদের বাড়ী থেকে মানুষ আসার কথা। মল্লিকা আনমনে বাসার ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ীতে কারা ঢুকছে কারা বের হচ্ছে উপর থেকে খেয়াল করছে সে। মনের মধ্যে কী যেনো এক বিষয় ছটফট করছে তার। কখনো যেন সমুদ্রের বুকে বিশাল গর্জন, কখনো আবার শান্তস্নিগ্ধ বাতাসের পরম তৃপ্তিময় ছোঁয়া।

হাতের মোবাইল থেকে ফেইসবুকে সাইন-ইন করলো মল্লিকা। ওরে বাহ্! আজ লিটন অতিশয় রোমান্টিক একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে। ‘একটি অঙ্গুরীয় শুধু একটি হাতের শোভা বর্ধনই করে না, দুটি হৃদয়কে এক করারও ক্ষমতা রাখে।’ তার আর বুঝতে বাকি নেই যে আজকের এনগেজমেন্টকে উদ্দেশ্য করেই সে এমন একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে। সত্যি বলতে কি ইদানিং লিটন দারুণ সব স্ট্যাটাস দেয়। কখনো মন খারাপের, কখনো আনন্দের আবার কখনো বা রোমান্টিক ধাচের। সবই ভালো লাগে তার, সব কিছুই ভালো লাগে।

সবাই চুপচাপ। একটু আগে যেন এইখান দিয়ে সাইক্লোন বয়ে গেছে। চারদিকে দুই পক্ষের মুরব্বীরা যে যার মতো বসে আছেন। ঠিক মধ্যখানে টুকটুকে লাল শাড়ি পড়ে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে মল্লিকা। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সুনসান নিরবতা।  হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন মল্লিকার দাদু।
- এ বিয়ে হবে না। কখনো হবেনা। একটা আস্ত ছোট লোকের কাছে আমার নাতনিকে বিয়ে দিতে পারি না।

দাদুর কথা শুনে মল্লিকার অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো। লিটন এমনটা করবে তা বিশ্বাসই হচ্ছে না। কোন একদিন লিটন মল্লিকাকে বলেছিল, বুঝলা মল্লিকা, তোমার বাগদানে আমি একটা নারকেল পাতার আংটি উপহার দিবো। সাথে একটা ঘড়িও থাকবে। ছোটবেলায় আমরা যেরকম ঘড়ি বানিয়ে হাতে দিতাম ঠিক সেরকম। পছন্দ হবে তো তোমার ?

লিটন এ নিয়ে দুষ্টুমি করেছিল ঠিক, তাই বলে এটা বাস্তবেই করে বসবে তা কল্পনাও করেনি । তার চরিত্রে কিছুটা হেয়ালিপনা ভাব লক্ষ্য করা যায়,  কিন্তু এতটা করা কি বেমানান নয় !  তাই বলে সত্যি সত্যি নারিকেলের পাতা দিয়ে আংটি বানিয়ে এনগেজমেন্ট হয় বুঝি!  এসব ভাবতেই মল্লিকার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল চলে আসে। লিটনের এমন উদ্ভট আচরণের জন্য তার শরীর গিজগিজ করছে এখন। তার ভয়, এমন খামখেয়ালীর জন্য বিয়েটা না ভেঙ্গে যায়!

ছিঃ ছিঃ ছিঃ এমন কান্ড তো জীবনেও দেখিনি বাবা। পাতার আংটি!  যত্ত ঢং!  তোদের সামর্থ্য না থাকলে আমাদের বলতে পারতে। আমরা একটা হীরার আংটি কিনে দিতাম। ঘরের কোণা থেকে বললেন মল্লিকার কাকিমা।

লিটনের বাবা সভাস্থলে এমন অপদস্থ হওয়াটা মানতে পারছেন না।  তাঁর শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। রাগে দাঁত দিয়ে কটকট করছেন তিনি। লিটনকে এই মুহূর্তে হাতের কাছে পেলে কি করতেন তা ঈশ্বরই জানেন।  ফাজলমোর একটা সীমা থাকা দরকার।  চকচকে আংটির বক্সের মধ্যে এমন একটা পাতার আংটি ঢুকিয়ে দিবে তা তিনি মানতেই পারছেন না । মল্লিকাকে যখন বক্সটি খুলে আংটি পড়াবেন তখনই লিটনের এমন কুকর্মটা ধরা পড়লো।

পুরো বাসা জুড়ে ফিসফিস শুরু হয়েছে। এ কী কান্ড!  এ কী কান্ড!  তাই বলে পাতার আংটি!!  আমাদের কী মানসম্মান বলে কিছু নেই!  অনেকট গলা ছেড়ে বললেন মল্লিকার ঠাকুরমা।
মল্লিকার মা তাঁর শাশুড়িকে বললেন-
- আহা মা, থামেন তো আপনি।
- আমি কেনো থামবো!  শুনো বৌমা, আমার বিয়েতে তোমার শশুর পাঁচ ভরি স্বর্ণের অলংকার দিয়েছিল। আর উনি কিনা নিয়ে এসেছেন পাতার আংটি!!  যত্তসব ধান্দাবাজি। ছোটলোক কোথাকার!  সব বন্ধ করো তোমরা, সবকিছু বন্ধ করো। সবাইকে বিদায় করে দাও। আমাদের মল্লিকাকে প্রয়োজনে ট্রাকের ড্রাইবারের সাথে বিয়ে দিবো তবুও ওদের সাথে সম্বন্ধ চলবে না। এক কথা আমার।

চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন এবার লিটনের দাদু। বয়স তাঁর আশি ছুঁইছুঁই। কথা বললে গলায় যেন কাপন ধরে। সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবীতে বেশ মানিয়েছে তাকে। শ্বেতশুভ্র পোশাকের মাঝে তাঁর মুখমন্ডলে ভর করেছে যেন রক্তিম দ্যুতি। তিনি কিছু বলতে চাচ্ছেন দেখে সবাই ফিসফাস বন্ধ করলো।

দেখুন, এই এক টুকরা মৃত স্বর্ণকে আমরা যে পরিমান দাম দিয়ে থাকি সে পরিমান দাম আমরা একটা জীবিত মানুষকেও দেই না। আচ্ছা বলুন তো দেখি,  এই স্বর্ণকে যদি মানবজাতি ব্যবহার না করে মাটিতে ফেলে রাখে তার কি কোনো মূল্য থাকবে ? তখন তো সেটি মাটির সমানও মূল্য পাবে না। বিয়েতে স্বর্ণ দিতে হবে, বাগদানে স্বর্ণ দিতে হবে, অন্নপ্রাশনে স্বর্ণ দিতে হবে। এ কী জ্বালা। আমরা কি এই কালচার থেকে বের হতে পারি না। স্বর্ণের কাছে কি আমরা আমাদের বিবেককে বিক্রি করে দিচ্ছি !

কনেপক্ষের একজন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। ধীরে ধীরে সবাই কথা ঠিক, কথা ঠিক বলে একে অন্যের দিকে তাকালেন। এবার যেন পরিবেশটা বরপক্ষের অনুকুলে চলে যাচ্ছে। সবাই যেন কথা বলার একটু সাহসও পেল তখন।

লিটনের মামা বললেন, আমাদের লিটন একটা সোনার টুকরো ছেলে। তার বিয়েতে স্বর্ণের আংটি দিলেই কি আর না দিলেই কি। মল্লিকা মামণি তো রাজরানীর মতোই থাকবে সেখানে।
এবার লিটনের দাদু গুটিগুটি পায়ে মল্লিকার কাছে গেলেন। বললেন,  তোমার হাতটা দাও তো দিদিমণি।  সে হাতটা বাড়িয়ে দিল। তার এক আঙুলে পাতার আংটিটা পড়িয়ে দিয়ে বললেন, তোদের ভালোবাসার ঘরটা সবুজময় হোক দিদিমণি। এবার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে তিনি আরেকটা ছোট্ট রঙ্গিন থলে বের করলেন। সবার দৃষ্টি তখন ঐ দিকে চলে গেল। হাতের তালুতে চিকচিক করছে জিনিসটি। মল্লিকার অনামিকায় তা আলতো করে পড়িয়ে দিলেন দাদু।

মল্লিকার চোখদুটি জ্বলজ্বল করে উঠলো তখন। সে বুঝতে পারলো এটা লিটনেরই কারসাজি। কোনো কিছুতে একটা চমক সৃষ্টি করাই তার শখ। মারাত্মক শখ।  মল্লিকা এবার পা বাড়ালো নিজের রুমের দিকে। সে কাঁদবে না হাসবে, বুঝতে পারছে না কিছুই।  উত্তেজনায় শুধু পা দুটো কাঁপছে তার। আগামী ৭ তারিখই যে তাদের বিয়ে!

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন