আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বই আলোচনা:: দীন শরৎ বলে

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৮-২৯ ২২:১৫:৫৯

সঞ্জয় সরকার :: গুরু উপায় বলো না/জনমদুঃখী কপাল পোড়া/আমি একজনা--- এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা বাউল সাধক দীন শরৎ। বিশ শতকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এই বাউল-কবির গান হাজারও শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে দেশের বৃহৎ ভাটি-বাংলার মানুষ তাঁর গান শুনে অভিভ‚ত, রোমাঞ্চিত ও আপ্লুত হয়েছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে দীন শরৎ এক বিস্মৃতপ্রায় নাম। কালের প্রবাহে ও লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া এই বাউল-কবিকে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন তরুণ লেখক পার্থ তালুকদার। দীন শরৎ-এর জীবন ও গানের ভান্ডারকে একত্রে সন্নিবেশিত করে তিনি লিখেছেন ‘দীন শরৎ বলে’ নামে একটি বই। গত (২০১৭) বইমেলায় রোদেলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ছয় ফর্মার বইটি। পেশায় ব্যাংকার হলেও লেখায় বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তরুণ গবেষক পার্থ। 

বাউল দীন শরৎ এর প্রকৃত নাম শরৎ চন্দ্র দেবনাথ। বোধকরি স্বয়ং ভাগ্য বিধাতাই তাঁর নামের সঙ্গে ‘দীন’ শব্দটি যুক্ত করেছেন। দীন শরৎ-এর জন্ম আজ থেকে প্রায় ১শ ১৪ বছর আগে, অর্থাৎ ১৩১০ বঙ্গাব্দে তৎকালীন নেত্রকোনা মহকুমার কেন্দুয়া উপজেলার সাজিউড়া গ্রামে। শিশুকাল থেকেই তিনি পিতা-মাতার স্নেহ-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হন। কারণ, দীন শরৎ যখন মাতৃগর্ভে তখন তাঁর পিতা কুটিশ্বর দেবনাথ মারা যান। আর তাঁর মা মারা যান মাত্র পাঁচ-ছয় বছর বয়সে। এ কারণে আজীবনই কাঁদতে হয়েছে তাঁকে, যা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অসংখ্য গানে ‘শিশুকালে মইরা গেল মা/গর্ভে থুইয়া পিতা মইল চোখে দেখলাম না/ আমায় কে করিবে লালন পালন গো/কে দিবে আজ সান্তনা।’ দীন শরৎ-এর দুঃখের কাহিনী এখানেই শেষ নয়। পিতৃ-মাতৃহীন দীন শরৎ যখন নানাজনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বড় হচ্ছিলেন ঠিক তখনও আবার মুখ ফিরিয়ে নেন ভাগ্য বিধাতা। টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে চির দিনের মতো চোখের আলো হারান তিনি। পার্থ তালুকদার লিখেছেন, ‘ভাবতে অবাক লাগে, এই অন্ধ দীন শরৎ বাংলা সাহিত্যকে উজাড় করে দিয়েছেন। এটা কোন পৌরাণিক কল্পকাহিনী নয়, এটা দীনশরৎ-এর জীনযুদ্ধের গল্প।’

‘দীন শরৎ বলে’ বই পাঠে আমরা জানতে পারি, হৃদয়ে পাহাড়সম দুঃখ নিয়ে তিনি গান রচনা করেছেন। দারিদ্র্যতার কালোমেঘে প্রায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল তাঁর মেধাজ্ঞান। কিন্তু আপন মহিমায় দারিদ্র্যতার কূল-কিনারাহীন সাগর পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। গানের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের পরম সত্যকে।

জানা যায়, সীমাহীন কষ্টের ভার ভুলতেই বাল্যকাল থেকে তিনি মুখে মুখে গান রচনা করতেন। রচনার পর তাতে সুর দিয়ে লোকজনকে গেয়ে শোনাতেন। আর এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরে বেঁচে থাকার অবলম্বন সংস্থান করতেন। এভাবে গান গাইতে গাইতে এক সময় তাঁর বেশকিছু সঙ্গী-সাথী জুটে যায়। সেই সঙ্গীদের দিয়েই তিনি গানগুলো কাগজে টুকে রাখতেন। এভাবে দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয় তাঁর বিশাল গানের ভান্ডারটি। জানা যায়, একটু বড় হওয়ার পর হবিগঞ্জের বিথঙ্গল (বিথলং) আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামীর সাক্ষাত পান তিনি। রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে তাঁর মনে ভক্তিবাদের উদয় হয়। এ জন্য তাঁর বহু গানে বৈষ্ণব ভাবধারার সন্ধান পাওয়া যায়। রাধাকৃষ্ণের রাগ-অনুরাগ, মিলন-বিরহ, মান-অভিমান বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর গানে। যেমন আমার সাধের শ্যাম সুখ পাখিটা উড়ে গেল কই/ সখি বলগো তোরা ত্বরা করে/ শ্যামের শোক কেমনে সই’। লালনপন্থী বাউলদের মাঝে যেমন সাধনসঙ্গী ও ভেক খিলাফত গ্রহণের রেওয়াজ প্রচলিত ছিল তেমনি নেত্রকোনা অঞ্চলের গৃহী বাউলদের মধ্যে প্রচলন ছিল পীর-ফকির ও সাধু-গুরুর দীক্ষা গ্রহণের। বাউল দীনশরৎও ছিলেন একজন গৃহী বাউল। রামকৃষ্ণের সান্নিধ্য গ্রহণ ছাড়াও তিনি ভারত গোস্বামীর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।

একটা সময়ে এসে শিষ্য-প্রশিষ্যদের মাধ্যমে দীন শরৎ-এর গান সমগ্র ভাটি মুল্লুকে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ বিষ্ময়ে তাঁকায় এই অন্ধ সাধকের দিকে। গানই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর জীবন-জীবিকার অবলম্বন। এরই মাঝে তাঁর ছন্নছাড়া জীবনে কিছুটা সুখের হাওয়াও লাগতে শুরু করে। দীন শরৎ-এর গান শুনে একদিন মুগ্ধ হন নিজ গ্রামের বাসিন্দা অবিভক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রী নলিনীরঞ্জন সরকার। তিনি তাঁকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দেন। শুধু তাই না, তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যাবারও ব্যবস্থা করেন। মূলত নলিনীরঞ্জন সরকারের সান্নিধ্যে আসার পরই তাঁর বাউল-প্রতিভা বৃহৎ পরিসরে বিস্তৃত করার সুযোগ আসে। নলিনীরঞ্জনের ভাই পবিত্ররঞ্জন সরকারের সহযোগিতায় কলকাতা থেকে ‘দীন শরতের বাউল গান’ নামে প্রথম গানের সংকলন প্রকাশিত হয়। বইটির অধিকাংশ গান দেহতত্ত্ব, পঞ্চতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব ও পরমার্থতত্ত্ব বিষয়ক। এছাড়া রয়েছে বৈষ্ণব সাধন পদ্ধতি, গৌরনিতাই ও রাধাকৃষ্ণতত্ত¡ বিষয়ক গান। এসব গানে প্রচুর সংস্কৃত শ্লোক ও এসবের ব্যাখ্যা রয়েছে। ‘দীন শরতের বাউল গান’ বইয়ের ভমিকায় কলকাতার শ্রী কামিনী কুমার কর রায় লিখেছেন ‘‘কোন প্রাীচন পুঁথিতে সংস্কৃত শ্লোক  পাইলেই আমরা সেই পুঁথির রচককে অসাধারণ সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত বলিয়া মনে করি। কিন্তু ‘দীন শরতের বাউল গান’ আমাদিগকে এইরূপ ধারণার ব্যাপারে সাবধান করিয়া দিতেছে। সংস্কৃত না জানিয়াও যে সংস্কৃত শ্লোকাদি লিখা ও ব্যাখ্যাা করা যায়, তাহা আমরা ‘দীন শরৎ’ হইতেই বুঝিতেছি।’’ প্রথম বই প্রকাশের কিছুকাল পরে ‘দীন শরতের এসলাম সঙ্গীত’ ও ‘গৌরগীতিকা’ নামে আরও দু’টি গানের সংকলন প্রকাশিত হয়। ‘এসলাম সঙ্গীত’ দীন শরৎ-এর বিষ্ময়কর সৃষ্টি। এ বইয়ের গানগুলোতে সৃষ্টিকর্তার মহিমাগীতি, অজুদনামা বা দেহতত্ত¡, নূরভাগ, আদমতত্ত্ব, মৌতনামা, নামাজনামা, আখেরতত্ত্বসহ ইসলাম ধর্মের খুটিনাটি বিষয় সম্পর্কে তাত্ত্বিক ব্যাখা দিয়েছেন তিনি। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে গান রচনা করে সমাজে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ বপন করতে চেয়েছেন এই সাধক। ভাটি অঞ্চলের অন্যতম লোকসঙ্গীত (কারও কারও মতে লোকনৃত্য) ধামাইল গান। প্রচুর ধামাইল গানও রচনা করেছেন এই লোককবি। 

বাউলদের প্রধান সৃষ্টি দেহতত্ত্ব। সাধক দীন শরৎ কত সাধনার মাধ্যমে তাঁর গানে দেহতত্তে¡র নিগূঢ় তত্ত¡কথার বর্ণনা করেছেনÑ তা তাঁর গানগুলি না শুনলে বা না পড়লে বিশ্বাস করা কঠিন। বাউল সাধনায় বলা হয়ে থাকে আত্মাকে জানার মাধ্যমেই পরমাত্মাকে জানা যায়। আর পরমাত্মার সন্ধানেই মিলে পরম শান্তি। আমাদের দেহস্থিত আত্মাকে জানতে বা উপলব্ধি করতে ব্যাপক সাধনা প্রয়োজন। আমাদের দেহের ইন্দ্রিয়গুলো সময়ে-অসময়ে ষড়রিপুর তাড়নায় কুপথগামী হয়ে থাকে। আর তাই কঠোর সাধনার মাধ্যমে ষড়রিপুকে বশ করতে হয়। মহান এই সাধক তাঁর গানে বলতে চেয়েছেন ‘দেহে দশটি জিলা চৌদ্দ পরগনা, ভ্রমিয়া আঠার থানা/ সবকে বাধ্য করলো এই ছয়জনা, কুমতির হয়ে ক্যানভাসার।’

বলাবহুল্য, দীন শরৎ বর্তমান কালে এক বিষ্মৃতপ্রায় নাম। আজকালকার বাউল বা শিল্পীদের কণ্ঠে খুব কমই তাঁর গান শোনা যায়। এছাড়া তাঁর গান সংগ্রহ বা প্রচারেরও উদ্যোগ নেয়নি কেউ। যতদূর জানা যায় সত্তর আশির দশকে চিত্র পরিচালক কামাল আহমেদ তাঁর ‘পুত্রবধূ’ চলচিত্রে ‘গুরু উপায় বলো না’ গানটি ব্যবহার করেন। শিল্পী মলয় কুমার ভৌমিকের গাওয়া এ গানটি আজও জনপ্রিয়। অনুমান করি, দীন শরৎ এমন আরও অনেক গান আছে যা শ্রোতাদের হৃদয় আকৃষ্ট করবে। কিন্তু দায়িত্বটি গ্রহণ করবেন কে? তরুণ লেখক পার্থ তালুকদারকে ধন্যবাদ বিষ্মৃতপ্রায় এই লোককবিকে কিছুটা সামনে আনার জন্য।

প্রসঙ্গত, বইটির কভার, বাঁধাই এবং মূদ্রণ বেশ পরিপাটি। বাউলের হাতে একতারা সম্বলিত দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকে বইটির শ্রীবৃদ্ধি করেছেন কাব্য করিম। ৯৬ পৃষ্ঠার বইটির দাম ধরা হয়েছে মাত্র ১শ ৬৫ টাকা। বিশ্বাস করি তথ্যসমৃদ্ধ বইটি পাঠের পর পাঠকমাত্রই পার্থ তালুকদারের প্রশসংসা করবেন।

সঞ্জয় সরকার, নিজস্ব সংবাদদাতা, দৈনিক জনকণ্ঠ
উকিলপাড়া, নেত্রকোনা-২৪০০, মোবাইল: ০১৭১২২৪৮৩৫০

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন