আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

রোহিঙ্গা ইস্যু এবং বাংলাদেশ সরকার

খালেদ সাইফুল্লাহ্ ইলিয়াছ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৮-৩১ ১৯:২২:৩৮

খালেদ সাইফুল্লাহ্ ইলিয়াছ :: সারা বিশ্বের জন্য বেদনাদায়ক একটি মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যাটি। আজ পবিত্র হজ্জের দিন, এই দিনও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানদের মনে দাগ কেটে যাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু । শুধুই কি রোহিঙ্গারা মুসলিম হওয়ার জন্যে ভেতরটা এত কেঁদে উঠছে, নাকি বিশ্ব মানবতার তরে এ প্রাণ কাঁদে। এ প্রশ্নের উত্তর এই মুহূর্তে দেয়া আমার কাছে মুশকিল।

তবে সমস্যা পর্যালোচনা করে আমার কাছে মনে হচ্ছে সমস্যাটা যতটা না ধর্মীয় তার থেকেও বেশি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির। আসুন দেখে নেয়া যাক রোহিঙ্গা ইস্যুর গভীরতা। রোহিঙ্গা ইস্যুটি প্রায় আশি বছরের পুরানো একটি ইস্যু। বার্মিজদের স্বাধীনতার উষালগ্ন থেকে এই ইস্যুটি বিদ্যমান। ১৯৩৬ সাল বার্মিজদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক মিস্টার নূ তখন রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি, রোহিঙ্গা নেতা এম এ রশিদ সহ-সভাপতি, সাধারন-সম্পাদক ইউ থিন হান, নোবেলবিজয়ী অং সান সুকির বাবা মিঃ অং সান ছিলেন সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক। ব্রিটিশ বিরোধী এক প্রবন্ধ প্রকাশের দায়ে নূ এবং অং সানকে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়।

এ ঘটনার প্রেক্ষিতে বিক্ষোভে ছড়িয়ে পড়ে সারা বার্মা জুড়ে। নড়ে চড়ে বসে ব্রিটিশ প্রশাসন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাধারন বার্মিজরা যোগ দেয় জাপানীদের পক্ষে, তখন রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের কথামত V-Force গঠন করে। V-Force জাপানিদের প্রতিরোধ করা বাদ দিয়ে শুরু করে সাধারন বার্মিজদের উৎখাত। একের পর এক ধর্ষণ হত্যা অগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে হত্যা করে ২২ হাজার বার্মিজ নাগরিককে।

১৯৪২ সালের শেষের দিকে জাপান বার্মা আক্রমণ করলে, সেই সুযোগে বার্মিজরা হত্যার প্রতিশোধ নিতে থাকে। সেই সময় নিহত হয় ৫ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক। প্রায় ১৮ হাজার নাগরিক পালিয়ে আসে চট্রগ্রামে। আজকের যে রোহিঙ্গা ইস্যু তার বীজ বপন হয়েছিল সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হলে, তখনকার পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের অবস্থান ছিলো। এম এ রশিদ প্রতিনিধিত্ব করতেন রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হয়ে। অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে যখন রোহিঙ্গারা আরকান মুসলিম লীগ গঠন করে। সেদিনকার মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জনক জিন্নাহর কাছে আবদার জানায় আরকানকে পাকিস্তানের সাথে একীভূত করার।

কিন্তু জিন্নাহ রোহিঙ্গাদের প্রস্তাবকে নাকচ করে দেন। তারপর রোহিঙ্গারা সাধারন জিহাদের ডাক দিয়ে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করে। ১৯৫৪ সালে বৌদ্ধ বিক্ষুরা রোহিঙ্গাদের অত্যাচারের প্রতিবাদে অনশন করে। এতেও লাভ হয়নি। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক দাঙ্গায় বহু লোক নিহত হয় উভয় পক্ষের। অবস্থা রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে চলে যায় যখন মিস্টার নূকে সামরিক বাহিনী উৎখাত করে। সামরিক জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের উপর দমন পীড়ন চালাতে থাকে।

১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গা বার্মিজ দাঙ্গায় প্রায় ২ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আসে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করলে সেই ২ লাখ রোহিঙ্গা আর কখনো ফেরত যায়নি মিয়ানমারে। তারপর থেকে সময়ে অসময়ে রোহিঙ্গারা সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে আসতে থাকে। বলা হয়ে থাকে ১৭ লক্ষ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৮ লক্ষ থাকে আরকানে ৭ লক্ষ বাংলাদেশে বাকি ২ লক্ষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি আবার সমগ্র বিশ্বের সামনে চলে আসে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কর্তৃক মিয়ানমারের পুলিশ চৌকিতে হামলা এবং মায়ানমার সরকারের দমন পীড়নের মধ্য দিয়ে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একের পর এক হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়ে তোলে।

রোহিঙ্গারা সীমানা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসতে থাকে। বিপাকে পড়ে যায় আমাদের সীমিত আয়ের জনবহুল দেশটি। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলতে থাকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সাধারন চোখ দিয়ে দেখলে, বাংলাদেশের হাতে করণীয় থাকে চারটি যেমন-
(১)আরকান দখল করে বাংলাদেশের সাথে একীভূত করা। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব না, কেননা অান্তর্জাতিক অনেক ইস্যু কাজ করবে এখানটাতে, হয়তো অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে পুরো বাংলাদেশ। তাছাড়া মায়ানমার সেনাবাহিনীর সক্ষমতা আমাদের বাহিনী অপেক্ষা কোনো অংশে কম নয়। অন্য কোনো সত্বার জন্য এতবড় ঝুকি নেয়া বোকামি ছাড়া কিছু নয়। আমরা যদি রাশিয়ার মত পরারাশক্তি হতাম তাহলে হয়তো বা সম্ভব ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য যতটুকু ত্যাগ স্বীকার করেছি তা কি রোহিঙ্গাদের জন্য করতে পারব?
(২) রোহিঙ্গাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করে স্বাধীন অারাকানের জন্ম দেয়া। আমার মতে এটাও বাস্তব সম্মত না, কেননা কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী ইসলামী গোষ্ঠী ছাড়া সাধারণ কোনো আরকানী পৃথক আরকান রাষ্ট্র চায়না। আর সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ব্যতীত পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র স্বাধীনতা পায়নি আর পাবেও না। আমাদের বজ্রকন্ঠ পিতা মুজিব ছিল, তাদের তেমন কেউ নেই যার অনুপ্রেরণা তাদেরকে জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত করবে স্বাধীনতা সংগ্রামে। তাই স্বাধীন আরকানের চিন্তা মাথা থেকে দূর করাই উত্তম।
(৩) সীমান্ত খু্লে দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রবেশাধিকার দেয়া এবং তাদের নাগরিকত্ব দেয়া। কিন্তু এটা করলে মায়ানমার সরকার যে উদ্দেশ্যে এই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তা সফল হয়ে যাবে। তাছাড়া আমাদের সে সক্ষমতাও নেই জনবহুল ছোট্র দেশটিতে এত বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার দায়িত্ব গ্রহণ করা।
(৪)সর্বশেষ যে পথটি খোলা আছে বাংলাদেশ সরকারের জন্য তা হলো মানবিক দিক বিবেচনা করে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা। এটিই করে যাচ্ছে জননেত্রী শেখহাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্রমাগত যোগাযোগ করে যাচ্ছে ওআইসি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া সহ অনান্য অান্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে। যার ফলশ্রুতিতে ওআইসি এবং যুক্তরাজ্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুটি উত্থাপনের অনুরোধ জানিয়েছে জাতিসংঘের কাছে। বাংলাদেশ কফি আনান কমিশনের প্রস্তাবনা এবং একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি যৌথ অভিযানেরও প্রস্তাব দিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে। আসলে এই প্রস্তাবনার বাইরে বিকল্প কোনো সমমাধান খোলা নেই আমাদের সরকারের সামনে।

সর্বপরি, আনান কমিশন ও বাংলাদেশের প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলেই কেবল রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান হওয়া সম্ভব। আমাদের প্রত্যাশা, রোহিঙ্গারা ফিরে পাক নাগরিকত্ব, ফিরে যাক নিজ ভূমে, বেঁচে থাক মানবতা।

লেখক: গ্রন্থণা ও প্রকাশনা সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন